ইমাম হোসেনের অশ্বের পদধ্বনি শ্রবণ করিয়া এজিদের সৈন্যগণ চমকিত হইল। সকলের অন্তর কীপিয়া উঠিল সকলেই দেখিতে লাগিল, হোসেন স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে আসিতেছেন। দেখিতে দেখিতে চক্ষের পলকে মহাবীর হোসেন যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়া উচ্চঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “ওরে পাপাত্মা এজিদ! তুই কোথায়? তুই নিজে দামেস্কে থাকিয়া নিরীহ সৈন্যদিগকে কেন রণস্থলে পাঠাইয়াছিসঃ আজ তোকে পাইলে জ্ঞাতিবধবেদনা, ভ্রাতৃপুত্র কাসেমের বিচ্ছেদবেদনা এবং স্বীয় পুত্রগণের বিয়োগবেদনা, সমস্তই আজ তোর পাপশোণিতে শীতল করিতাম। ওরে অর্থলোভী পিশাচেরা, ধর্মভয় বিসর্জন দিয়া আমার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিয়াছিস! আয় দেখি, কে সাহস করিয়া আমার অস্ত্রের সম্মুখে আসিবি, আয়! আর বিলম্ব কেন?
এজিদপক্ষীয় সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা আবদুর রহমান; হোসেনের সহিত যুদ্ধ করিতে তাহার চিরসাধ। অশ্বপৃষ্ঠে আরোহন করিয়া সেই আবদুর রহমান অসি চালনা করিতে করিতে হোসেনের সন্মুখে আসিয়া বলিতে লাগিল, “হোসেন! তুমি আজ শোকে তাপে মহা কাতর; বোধহয়, আজ দশ দিন তোমার পেটে অন্ন নাই; পিপাসায় কণ্ঠতালু বিশুষ্ক; এই কয়েকদিন কেন বাঁচিয়া আছ বলিতে পারি না। আর কষ্ট ভোগ করিতে হইবে না, শীঘ্রই তোমার মনের দুঃখ নিবারণ করিতেছি। বড় দর্পে অশ্মচালনা করিয়া বেড়াইতেছ; এই আবদুর রহমান তোমার সনুখে দীড়াইল, যত বল থাকে, অগ্ে তুমি আমাকে আঘাত কর । তোমার বল বুঝিয়া দেখি; যদি আমার অস্ত্রাঘাত সহ্য করিবার উপযুক্ত হও, আমি প্রতিঘাত করিব; নতুবা ফিরিয়া যাইয়া তোমার ন্যায় হীন, ক্ষীণ, দুর্বল যোদ্ধাকে খুঁজিয়া তোমার সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাইয়া দিব।
হোসেন বলিলেন, “এত কথার প্রয়োজন নাই! আমার বংশমধ্যে কিংবা জ্ঞাতিমধ্যে অগ্ধে অস্ত্র নিক্ষেপের রীতি থাকিলে তুমি এত কথা কহিবার সময় পাইতে না। অস্ত্রই বল পরীক্ষার প্রধান উপকরণ! কেন বিলম্ব করিতেছিস? যে কোনো অস্ত্র হউক, একবার নিক্ষেপ করিলেই তোর যুদ্ধসাধ মিটাইতেছি। বিলে তোর মঙ্গল বটে, কিন্তু আমার অসহ্য ।”
হোসেনের মস্তক লক্ষ্য করিয়া তরবারি উত্তোলনপূর্বক “ তোমার মস্তকের মূল্য লক্ষ টাকা!” এই বলিয়া আবদুর রহমান ভীম তরবারি আঘাত করিল। হোসেনের বর্মোপরি আবদুর রহমানের তরবারিসংলগ্ন হইয়া অগ্নিস্ষুলিঙ্গ বর্হিগত হইল। রহমান লঙ্জিত হইয়া পলায়নের উপক্রম করিল। হোসেন বলিলেন, “অগ্রে সহ্য কর, শেষে পলায়ন করিস।” কেহই আর হোসেনের সম্মুখীন হইতে সাহস করিল না। বলিতে লাগিল, “যদি হোসেন আজ এ সময় পিপাসা নিবারণ করিতে বিন্দুমাত্রও জল পায়, তাহা হইলে আমাদের একটি প্রাণীও ইহার হস্ত হইতে প্রাণ বাচাইতে পারিবে না। যুদ্ধ যতই হউক, বিশেষ সতর্ক হইয়া দ্বিগুণ সৈন্য দ্বারা ফোরাতকুল এখন ঘিরিয়া রাখাই কর্তব্য । যে মহাবীর এক আঘাতে আবদুর রহমানকে নিপাতিত করিল, তাহার সম্মুখে কে সাহস করিয়া দাড়াইবে? আমরা রহমানের গৌরবেই চিরকাল গৌরব করিয়া বেড়াই, তাহারই যখন এ দশা হইল, তখন আমরা তো হোসেনের অশ্বপদাঘাতেই গলিয়া যাইব।” পরস্পর এইরূপ বলাবলি করিয়া সকলেই একমতে দ্বিগুণ সৈন্য দ্বারা বিশেষ সুদৃঢ়রূপে ফোরাতকুল বন্ধ করিল।
হোসেন অনেকক্ষণ পর্যন্ত সমরাঙ্গনে কাহাকেও না পাইয়া শক্রশিবিরাভিমুখে অশ্বচালনা করিলেন । তদ্দর্শনে অনেকেরই প্রাণ উড়িয়া গেল। কেহ অশ্বপদাঘাতে নরকে গমন করিল, কেহ কেহ সাহসের উপর নির্ভর করিয়া হোসেনের সম্মুখে সশস্ত্র হইয়া দাড়াইল।
অবশিষ্ট সৈন্যগণ কারবালা পার্থস্থ বিজন বনমধ্যে পালাইয়া প্রণরক্ষা করিল। ওমর, সীমার, আবদুল্লাহ জেয়াদ প্রভৃতি সকলেই হোসেনের ভয়ে বনমধ্যে লুকাইলেন।
শত্রুপক্ষের শিবিরস্থ সৈন্য একেবারে নিঃশেষিত করিয়া হোসেন ফোরাতকূলের দিকে অশ্ব চালাইলেন। ফোরাতরক্ষীরা হঠাৎ পলাইল না, কিন্তু অতি অল্পক্ষণ হোসেনের অসির আঘাত সহ্য করিয়া আর তিষ্ঠিবার সাধ্য হইল না। যে এজিদের সৈন্যকোলাহলে প্রচণ্ড কারবালা প্রান্তর, সুপ্রশস্থ ফোরাতকূল ঘন ঘন বিকম্পিত হইত; এক্ষণে হোসেনের অস্ত্রাঘাতে সেই কারবালা একেবারে জনশূন্য নীরব প্রান্তর; শীঘ্র শীঘ্র ফোরাতকূলে যাইয়া অশ্ব হইতে অবতরণপূর্বক একেবারে জলে নামিলেন। জলের পরিষ্কার স্নিগ্ধ ভাব দেখিয়া ইচ্ছা করিলেন যে, এককালে নদীর সমুদয় জল পান করিয়া ফেলেন। অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলিয়া মুখে দিবেন, এমন সময় সমুদয় কথা। মনে পড়িল; আলী আকবর প্রভৃতির কথা মনে পড়িল, পিপাসার্ত দুগ্ধপোষ্য শিশুর কথা মনে পড়িল। একবিন্দু জলের জন্য ইহারা কত লালায়িত হইয়াছে, কত কাতরতা প্রকাশ করিয়াছে, কত কষ্টভোগ করিয়াছে, “এই জলের নিমিত্তই আমার পরিজনেরা পুত্রহারা, পতিহারা, ভ্রাতৃহারা হইয়া মাথা ভাঙ্গিয়া মরিতেছে, আমি এখন শত্রুহস্ত হইতে ফোরাতকূল উদ্ধার করিয়া সর্বাগ্রেই নিজে সেই জল পান করিব! – নিজের প্রাণ পরিতৃপ্ত করিব! আমার প্রাণের মায়াই কি এত অধিক হইল! ধিক্ আমার প্রাণে! – এই জলের জন্য আলী আকবর আমার জিহ্বা পর্যন্ত চুষিয়াছে। একপাত্র জল পাইলে আমার বংশের উজ্জ্বল মণি মহাবীর কাসেম আজ শত্রুহস্তে প্রাণত্যাগ করিত না। এখনো যাহারা জীবিত আছে তাহারাও তো শোকতাপে কাতর হইয়া পিপাসায় মৃতবৎ হইয়া রহিয়াছে। এ জল আমি কখনোই পান করিব না, ইহজীবনেও আর পানি পান করিব না।” এই কথা বলিয়া- হস্তস্থিত জল নদীগর্ভে ফেলিয়া দিয়া তীরে উঠিলেন। একবার আকাশের দিকে লক্ষ্য করিয়া পবিত্র শিরস্ত্রাণ শির হইতে দূরে নিক্ষেপ করিলেন। দুই-এক পদ অগ্রসর হইয়া কোমর হইতে কোমরবন্ধ খুলিয়া দূরে ফেলিয়া দিলেন। ভ্রাতৃশোক, পুত্রশোক, সকল শোক একত্র আসিয়া তাঁহাকে যেন দগ্ধ করিতে লাগিল। অস্ত্রশস্ত্র দূরে নিক্ষেপ করিয়া ফোরাতস্রোতের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন। হোসেনের অশ্ব প্রভুর হস্ত, পদ ও মস্তক শূন্য দেখিয়াই যেন মহাকষ্টে দুই চক্ষু হইতে অনবরত বাষ্পজল নির্গত করিতে লাগিল। আবদুল্লাহ জেয়াদ, ওমর, সীমার আর কয়েকজন সৈনিক যাহারা জঙ্গলে লুকাইয়াছিল তাহারা দূর হইতে দেখিল যে, ইমাম হোসেন জলে নামিয়া অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলিয়া পুনরায় ফেলিয়া দিলেন, পান করিলেন না। এতদ্দর্শনে ঐ কয়েকজন একত্রে ধনুর্বাণ হস্তে হোসেনকে ঘিরিয়া ফেলিল। হোসেন স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া আছেন, কাহাকেও কিছু বলিতেছেন না।
স্থিরভাবে স্থিরনেত্রে ধনুর্ধারী শত্রুদিগকে দেখিতেছেন, মুখে কোনো কথা নাই। এমন নিরস্ত্র অবস্থায় শত্রুহস্তে পতিত হইয়া মনে কোনো প্রকার শঙ্কা নাই। অন্যমনস্কে কী ভাবিতেছেন তাহা ঈশ্বরই জানেন, আর তিনি জানেন। ক্ষণকাল পরে তিনি ফোরাতকূল হইতে অরণ্যাভিমুখে দুই-এক পদ অগ্রসর হইতে লাগিলেন। শত্রুগণ চতুষ্পার্শ্বে দূরে দূরে তাঁহাকে ঘিরিয়া চলিল। যাইতে যাইতে জেয়াদ পশ্চাদ্দিক হইতে তাঁহার পৃষ্ঠ লক্ষ করিয়া এক বিষাক্ত লৌহশর নিক্ষেপ করিল। ভাবিয়াছিল যে, এক শরে পৃষ্ঠ বিদ্ধ করিয়া বক্ষস্থল ভেদ করিবে, কিন্তু ঘটনাক্রমে সে শর হোসেনের বামপার্শ্ব দিয়া চলিয়া গেল, গাত্রে লাগিল না। শব্দ হইল, সে শব্দে হোসেনের ধ্যানভঙ্গ হইল না। তাহার পর ক্রমাগতই শর নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল। কিন্তু একটিও ইমামের অঙ্গে বিদ্ধ হইল না। সীমার শরসন্ধানে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন না বলিয়াই খঞ্জর হস্তে করিয়া যাইতেছিলেন।
এত তীর নিক্ষিপ্ত হইতেছে, একটিও হোসেনের অঙ্গে লাগিতেছে না। কী আশ্চর্য! সীমার এই ভাবিয়া জেয়াদের হস্ত হইতে তীরধনু গ্রহণপূর্বক হোসেনের পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করিয়া একটি শর নিক্ষেপ করিলেন। তীর পৃষ্ঠে লাগিয়া গ্রীবাদেশের একপার্শ্ব ভেদ করিয়া চলিয়া গেল। সেদিকে হাসানের ভ্রুক্ষেপ নাই। এমন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন আছেন যে, শরীরের বেদনা পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছেন। যাইতে যাইতে অন্যমনষ্কে একবার গ্রীবাদেশে বিদ্ধস্থান হস্ত দিয়া ঘর্ষণ করিলেন। জলের ন্যায় বোধ হইল; করতলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেন জল নহে-গ্রীবানিঃসৃত সদ্যরক্ত! রক্তদর্শনে হোসেন চমকিয়া উঠিলেন। আজ ভয়শূন্য মনে ভয়ের সঞ্চার হইল। সভয়ে চতুর্দিকে চাহিয়া দেখিলেন- আবদুল্লাহ জেয়াদ, অলীদ, ওমর, সীমার এবং আর কয়েকজন সেনা চতুর্দিক ঘিরিয়া যাইতেছে। সকলের হস্তেই তীরধনু। ইহা দেখিয়াই চমকিত। যে সমুদয় বসনের মাহাত্ম্যে নির্ভয় হৃদয় ছিলেন- তৎসমুদয় পরিত্যাগ করিয়াছেন; তরবারি, তীর, নেজা, বল্লম, বর্ম, খঞ্জর কিছুই সঙ্গে নাই, কেবল দুখানি হাত মাত্র। অন্যমনস্কভাবে দুই-এক পদ করিয়া চলিলেন; শত্রুরাও পূর্ববৎ ঘিরিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
কিছু দূরে যাইয়া হোসেন আকাশপানে দুই-তিন বার চাহিয়া ভূ-তলে পড়িয়া গেলেন। বিষাক্ত তীরবিদ্ধ ক্ষতস্থানের জ্বালা, পিপাসার জ্বালা, শোকতাপ, বিয়োগ দুঃখ- নানা প্রকার জ্বালায় অধীর হইয়া পড়িলেন। জেয়াদ এবং ওমর প্রভৃতি ভাবিল যে, হোসেনের মৃত্যু হইয়াছে। কিছুক্ষণ পরে হস্তপদ সঞ্চালনের ক্রিয়া দেখিয়া নিশ্চয় হোসেনের মৃত্যু মনে করিল না, মৃত্যু নিকটবর্তী জ্ঞান করিয়া কিঞ্চিৎ দূরে স্থিরভাবে দণ্ডায়মান রহিল।
হোসেন জীবিত আছেন। উঠিবার শক্তি নাই। অন্যমনস্কে কী চিন্তায় অভিভূত ছিলেন তিনিই জানেন। চক্ষু মেলিয়া বক্ষের উপর খঞ্জরহস্তে সীমারকে দেয়িা বলিতে লাগিলেন, “তুমি ঈশ্বরের সৃষ্ট জীর- তুমি আমার বক্ষের উপর বসিলে?”
“সীমার! আমি এখনই মরিব! বিষাক্ত তীরের আঘাতে আমি অস্থির হইয়াছি। বক্ষের উপর হইতে নামিয়া
আমায় নিশ্বাস ফেলিতে দাও। একটু বিলম্ব কর। একটু বিলম্বের জন্য কেন আমাকে কষ্ট দিবে? আমার প্রাণ,
‘বাহির হইয়া গেলে মাথা কাটিয়া লইও। একবার নিশ্বাস ফেলিতে দাও! আজ নিশ্চয়ই আমার মৃত্যু। ক্ষণকাল অপেক্ষা কর।”
অতি কর্কশস্বরে সীমার বলিল, “আমি তোর বুকের উপর চাপিয়া বসিয়াছি, মাথা না কাটিয়া উঠিব না। যদি অন্য কোনো কথা থাকে, বল। বুকের উপর হইতে একটুও সরিয়া বসিব না।”
হোসেন বলিলেন, “সীমার! তাহা হইলে শ্যীঘ্রই মাথা কাটিয়া ফেল! অনর্থক আমাকে কষ্ট দিয়া তোমার কী লাভ হইতেছে? বন্ধুর কার্য কর।”
“আমি তো সাধ্যানুসারে চেষ্টা করিতেছি। খঞ্জরে না কাটিলে আমি আর কী করিব।”
হোসেন বলিলেন, “সীমার! তোমার বক্ষের বসন খোল দেখি?”
“কেন?”
“কারণ আছে। তোমার বক্ষ দেখিলেই আমি জানিতে পারিব যে তুমি আমার কাতেল (হন্তা) কি না।”
“তাহার অর্থ কী?”
“অর্থ আছে। অর্থ না থাকিলে বৃথা তোমাকে এমন অনুরোধ করিব কী জন্য? মাতামহ বলিয়া গিয়াছেন, রক্তমাংসে গঠিত দেহ হইলেও যে বক্ষ লোমশূন্য তাহার হস্তেই তোমার নিশ্চয় মৃত্যু। মাতামহের বাক্য অলঙ্ঘনীয়। সীমার তোমার বস্ত্র খুলিয়া ফেল। আমি দেখি, যদি তাহা না হয় তবে তুমি বৃথা চেষ্টা করিবে কেন?
সীমার গাত্রের বসন উন্মোচন করিয়া হোসেনকে দেখাইল। নিজেও দেখিল। হোসেন সীমারের বক্ষের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দুই হস্তে দুই চক্ষু আবরণ করিলেন। বার বার খঞ্জর ঘর্ষণে হোসেন বড়ই কাতর হইলেন। পুনরায় সীমারকে বলিতে লাগিলেন, “আর একটি কথা আমার মনে হইয়াছে, বুঝি তাহাতেই খঞ্জরের ধার ফিরিয়া গিয়াছে, তোমার পরিশ্রম বৃথা হইতেছে, সীমার! মাতামহ জীবিতাবস্থায় অনেক সময় স্নেহ করিয়া আমার গলদেশ চুম্বন করিয়াছিলেন। সেই পবিত্র ওষ্ঠের চুম্বন মাহাত্ম্যেই তীক্ষ্ণধার অস্ত্র ব্যর্থ হইয়া যাইতেছে।”
“না, তাহা কখনোই হইবে না। এরূপ কিছুতেই কার্যসিদ্ধ হইবে না। দেখ নিশ্বাস ফেলিতে আমার বড়ই কষ্ট হইতেছে। শীঘ্র শীঘ্র তোমার কার্য শেষ করিলে তোমারও লাভ, আমারও কষ্ট নিবারণ। তুমি ঐ তীরবিদ্ধ স্থানে খঞ্জর বসাও, এখনই ফল দেখিতে পাইবে।”
“তোমার কথা শুনিলে আমার কী লাভ হইবে?”
“অনেক লাভ হইবে! আমি ধর্মত প্রতিজ্ঞা করিতেছি, পরকালে তোমাকে অবশ্যই মুক্ত করাইব। পুনঃ পুনঃ ঈশ্বরের নাম করিয়া আমি ধর্মত প্রতিজ্ঞা করিতেছি, তোমাকে স্বর্গে লইয়া যাইতে না পারিলে আমি কখনই স্বর্গের দ্বারে পদনিক্ষেপ করিব না। ইহা অপেক্ষা তুমি আর কী লাভ চাও ভাই?”
হোসেনের বক্ষ পরিবর্তন করিয়া সীমার তাঁহার পৃষ্ঠোপরি বসিল। ইমামের দুইখানি হস্ত দুইদিকে পড়িয়া গেল, -দেখাইতে লাগিল, “জগৎ দেখুক, আমি কী অবস্থায় চলিলাম! নূরনবী মোহাম্মদের দৌহিত্র, মদিনার রাজা, -মহাবীর আলীর পুত্র হইয়া শূন্যহস্তে সীমারের অস্ত্রাঘাতে কীভাবে আমি ইহ সংসার হইতে বিদায় লইলাম! জগৎ দেখুক!”
আকাশ, পাতাল, অন্তরীক্ষ, অরণ্য, সাগর, পর্বত, বায়ু ভেদ করিয়া চতুর্দিক হইতে রব হইতে লাগিল, “হায় হোসেন! হায় হোসেন!!”
বিচ্ছেদবেদনা – বিচ্ছেদ বা দূরত্ব তৈরি হওয়ার জন্য বেদনা। মৃত্যুর ব্যথা অর্থেও বিচ্ছেদবেদনা ব্যবহৃত হয়।
শব্দার্থ ও টীকা
শব্দ | শব্দার্থ ও টীকা |
---|---|
পাপাত্মা | পাপে পূর্ণ আআ। এখানে পাপী। |
দামেস্ক | ইরাকের একটি স্থান। |
রণস্থল | রণ অর্থ যুদ্ধ, স্থল অর্থ স্থান। রণস্থল হলো যুদ্ধ করার স্থান। |
জ্ঞাতিবধবেদনা | আত্মীয় হত্যার যন্ত্রণা। |
বিচ্ছেদবেদনা | বিচ্ছেদ বা দূরত্ব তৈরি হওয়ার জন্য বেদনা। মৃত্যুর ব্যথা অর্থেও বিচ্ছেদবেদনা ব্যবহৃত হয়। |
স্বীয় | নিজ। |
বিয়োগবেদনা | কারো মৃত্যুর কারণে তৈরি হওয়া ব্যথা। |
পাপশোণিত | পাপের রক্ত। |
পিশাচ | সাধারণত ভূত প্রেত ইত্যাদি বোঝায় শব্দটি দ্বারা, কিন্তু এখানে পাপী, অমানুষ হিসেবে বোঝানো হয়েছে। |
অশ্বপৃষ্ঠ | ঘোড়ার পিঠ। |
আরোহণ | ওঠা। যেমন: ঘোড়ায় আরোহণ। |
অসি | তরবারি। |
দর্প | অহংকার। |
জ্ঞাতি | আত্মীয়স্বজন। |
অগ্রে | আগে। |
ভীম | ভীষণ, ভয়ঙ্কর। |
বহির্গত | বের হওয়া। |
নিবারণ | নিবৃত্ত করা। থামানো। |
ফোরাতকূল | ফোরাত নদীর তীর। ইরাক অঞ্চলের নদী। |
নিপাতিত | পতিত করা। |
অশ্বপদাঘাত | ঘোড়ার পায়ের আঘাত। |
সমরাঙ্গন | সমর ও অঙ্গন মিলে সমরাঙ্গন, অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্র। |
শত্রুশিবিরাভিমুখ | শত্রু যেখানে অবস্থান করে সেই দিকে। |
তদ্দর্শনে | তা দেখে। |
বিজন | জনমানব নেই এমন। |
তিষ্ঠিবার | অপেক্ষা করার, ধৈর্য ধরার, সহ্য করার ইত্যাদি বোঝায়। |
কারবালা | ইরাক অঞ্চলের বিখ্যাত ময়দান, এখানেই এজিদ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয় ইমাম হোসেনের। |
অবতরণপূর্বক | নেমে। |
অঞ্জলিপূর্ণ | আঁজলা ভরা। |
লালায়িত | লোভযুক্ত। |
মৃতবৎ | মৃতের মতো। |
শিরস্ত্রাণ | বর্ম। |
ধনুর্বাণ | ধনুক ও তার তীর। |
এতদ্দর্শনে | তা দর্শন করে, তা দেখে। |
ধনুর্ধারী | ধনুক ধারণ করে আছে যে। |
অরণ্যাভিমুখে | অরণ্যের অভিমুখে। |
চতুষ্পার্থে | চার পাশে। |
লৌহশর | লোহার তির। |
শরসন্ধানে | নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে ধনুকে তির স্থাপন । |
খঞ্জর | চাকু, ছুরি। |
গ্রীবাদেশ | ঘাড়, গলদেশ। |
নেজা | বর্শা। |
বল্লম | বর্শা। |
পূর্ববৎ | আগের মতো। |
ভূতল | মাটি। |
সঞ্চালন | নড়ানো। |
অন্তরীক্ষ | আকাশ। |
লেখক-পরিচিতি
লেখক-পরিচিতি | মীর মশাররফ হোসেন |
---|---|
জন্ম | ১৩ই নভেম্বর ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দ, কুষ্টিয়া জেলা, লাহিনীপাড়া |
পিতা | মীর মোয়াজ্জেম হোসেন |
শিক্ষাগত স্তর | প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর অগ্রসর, কিন্তু ছাত্রজীবনে “সংবাদ প্রভাকর” পত্রিকায় রচনা প্রকাশিত হয় |
চাকরি | ফরিদপুর নবাব এস্টেটে ও দেলদুয়ার এস্টেটে চাকরি, কলকাতা ও পদমদিতে অনেক দিন অবস্থান করেন |
সাহিত্যিক কর্ম | “সংবাদ প্রভাকর” পত্রিকায় রচনা প্রকাশ, মুসলিম রচিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সমন্বয়ধর্মী ধারার প্রবর্তক |
রচনার উদাহরণ | নাটক: “বসন্তকুমারী”, “জমিদার দর্পণ” এবং অনেক গদ্য রচনার মধ্যে “বিষাদ-সিন্ধু”, “নিয়তি কি অবনতি”, “উদাসীন পথিকের মনের কথা”, “গাজী মিয়ার বস্তানী”, “ফাস কাগজ” মহাকাব্যধর্মী উপন্যাস |
মৃত্যুবরণ | ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ শে ডিসেম্বর |
পাঠ পরিচিতি
“কারবালা-প্রান্তর” গদ্যাংশটি মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসের একটি অংশ। এখানে দেখা যাচ্ছে, ফোরাত নদীর উপকূলে কারবালার প্রান্তরে এজিদ-বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন হোসেন। তিনি নবি হযরত মোহাম্মদের (সা.) কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.) ও জামাতা হযরত আলির (রা.) পুত্র। ক্ষমতালোভী এজিদ ষড়যন্ত্র করে হোসেনের ভাই হাসান, হাসানের পুত্র কাসেমসহ পরিবারের অনেক সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ‘কারবালা-প্রান্তরে’ দেখা যাচ্ছে হোসেন নিজেই যুদ্ধে নেমেছেন। যুদ্ধে এজিদ নিজে অনুপস্থিত দেখে হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। কারণ এজিদ পাঠিয়েছে নিরীহ সৈনিকদের। তবু যুদ্ধের প্রয়োজনে প্রচণ্ড লড়াই করে তিনি পরাজিত করলেন এজিদ-পক্ষের সেনাদের। এক সময় তৃষ্ণার্ত হয়ে ফোরাত নদীর পানি পান করতে গেলেন। তাঁর মনে পড়ল পানির অভাবে মৃত্যুবরণ করা পরিবার-স্বজনদের কথা। হোসেন আঁজলায় তুলে নেয়া পানি ফেলে দিলেন। মগ্ন হয়ে ভাবছিলেন হারানো স্বজনদের কথা। সে সময় লুকিয়ে থাকা শত্রুরা তাঁকে আঘাত করল। সীমারের ছুঁড়ে দেয়া বিষাক্ত তিরে বিদ্ধ হলেন তিনি। গভীর যন্ত্রণায় কাতর হলেন। হোসেনের হাতে তখন কোনো অস্ত্র নেই। সে সুযোগে সীমার তাঁর গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করল। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। কেননা হযরত মোহাম্মদ (সা.) ছোট হোসেনকে আদর করে গলায় চুমু খেতেন। হোসেন সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে সীমারকে তাঁর পিঠের ওপর বসে ছুরি চালাতে বললেন। সীমারকে আশ্বাস দিলেন মৃত্যুর পর সীমারকে না নিয়ে স্বর্গে যাবেন না। সীমার তা-ই করল। মর্মান্তিকভাবে শহিদ হলেন হোসেন। গল্পের এ অংশে প্রকাশিত হয়েছে হোসেনের বীরত্ব, স্বজনদের প্রতি ভালোবাসা, যুদ্ধনীতি ও আত্মত্যাগ।”কারবালা-প্রান্তর” গদ্যাংশটি মীর মশাররফ হোসেন রচিত ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসের একটি অংশ। এখানে দেখা যাচ্ছে, ফোরাত নদীর উপকূলে কারবালার প্রান্তরে এজিদ-বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন হোসেন। তিনি নবি হযরত মোহাম্মদের (সা.) কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.) ও জামাতা হযরত আলির (রা.) পুত্র। ক্ষমতালোভী এজিদ ষড়যন্ত্র করে হোসেনের ভাই হাসান, হাসানের পুত্র কাসেমসহ পরিবারের অনেক সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ‘কারবালা-প্রান্তরে’ দেখা যাচ্ছে হোসেন নিজেই যুদ্ধে নেমেছেন। যুদ্ধে এজিদ নিজে অনুপস্থিত দেখে হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। কারণ এজিদ পাঠিয়েছে নিরীহ সৈনিকদের। তবু যুদ্ধের প্রয়োজনে প্রচণ্ড লড়াই করে তিনি পরাজিত করলেন এজিদ-পক্ষের সেনাদের। এক সময় তৃষ্ণার্ত হয়ে ফোরাত নদীর পানি পান করতে গেলেন। তাঁর মনে পড়ল পানির অভাবে মৃত্যুবরণ করা পরিবার-স্বজনদের কথা। হোসেন আঁজলায় তুলে নেয়া পানি ফেলে দিলেন। মগ্ন হয়ে ভাবছিলেন হারানো স্বজনদের কথা। সে সময় লুকিয়ে থাকা শত্রুরা তাঁকে আঘাত করল। সীমারের ছুঁড়ে দেয়া বিষাক্ত তিরে বিদ্ধ হলেন তিনি। গভীর যন্ত্রণায় কাতর হলেন। হোসেনের হাতে তখন কোনো অস্ত্র নেই। সে সুযোগে সীমার তাঁর গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করল। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। কেননা হযরত মোহাম্মদ (সা.) ছোট হোসেনকে আদর করে গলায় চুমু খেতেন। হোসেন সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে সীমারকে তাঁর পিঠের ওপর বসে ছুরি চালাতে বললেন। সীমারকে আশ্বাস দিলেন মৃত্যুর পর সীমারকে না নিয়ে স্বর্গে যাবেন না। সীমার তা-ই করল। মর্মান্তিকভাবে শহিদ হলেন হোসেন। গল্পের এ অংশে প্রকাশিত হয়েছে হোসেনের বীরত্ব, স্বজনদের প্রতি ভালোবাসা, যুদ্ধনীতি ও আত্মত্যাগ।
বহুনিরবাচনি প্রশ্ন
১। এজিদ পক্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা কে?
ক. সীমার
খ. আব্দুলাহ জেয়াদ
গ. ওমর
ঘ. আবদুর রহমান
২। অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলেও ইমাম হোসেন পান করলেন না কেন?
ক. ফোরাতকূলের জল নোংরা ছিল
খ. শত্রুপক্ষ বাধা দিয়েছিল
গ. স্বজনরা জলবিনা মারা গিয়েছিল
ঘ. ফোরাতকূলে পৌঁছে তৃষ্ণা ছিল না
উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও।
১৯৭১ সালের জুলাই মাস। মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় সারা দেশ উত্তাল। মা’র সাথে দেখা করতে এসে মুক্তিযোদ্ধা শফিক দেখলো পুরো গ্রাম জনশূন্য, গ্রামের স্কুলঘরকে পাকবাহিনী তাদের ক্যাম্প বানিয়েছে। দেরি না করে একাই আক্রমণ করে মিলিটারি ক্যাম্প। দু’একজন পালিয়ে বাচঁলেও অধিকাংশই শফিকের গুলিতে প্রাণ হারায়।
৩। উদ্দীপকের শফিক এর কাজ ‘কারবালা-প্রান্তর’ রচনার কোন চরিত্রের কাজের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ?
ক. এজিদ
খ. আবদুর রহমান
গ. সীমার
ঘ. ইমাম হোসেন
৪. উক্ত সাদৃশ্যের কারণ-
i. বীরত্ব
ii. দেশপ্রেম
iii. স্বাজাত্যবোধ
নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i. ও ii
খ. ii ও iii
গ. i ও iii
ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন
১.নিচের উদ্দীপকটি পড়ে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দাও ।
উদ্দীপক-১
মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর অল্প বয়সেই মধ্য এশিয়ার সমরখন্দের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ভারতের ইবরাহীম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন । আবার মেবারের রাজা সংগ্াম সিংহকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
উদ্দীপক-২
বাবরের ভারত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা মেনে নিতে পারেনি রাজপুতগণ । তাই তরুণ বীর রণবীর চৌহান বাবরকে হত্যার উদ্দেশ্যে দিল্লির পথে পথে ঘুরতে থাকে; ঘটনাক্রমে পেয়েও যায় । বাবরের এক মহত্টের ঘটনায় চৌহান সুগ্ধ হয় এবং অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি প্রার্থনা করে । সমস্ত ঘটনা জেনে বাবর তাকে বুকে টেনে নেন এবং দেহরক্ষী নিযুক্ত করেন।
ক. ইমাম হোসেনকে অস্ত্রহীন দেখে কে অনবরত অশ্রু বিসর্জন করেছিল?
খ. “ইহজীবনেও আর পানি পান করিব না’_ ইমাম হোসেনের এই প্রতিজ্ঞার কারণ বুঝিয়ে লেখ ।
গ. উদ্দীপক-২ অংশে ইমাম হোসেন চরিত্রের যে বিশেষ দিকটির প্রতিফলন লক্ষণীয় তা ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও সম্রাট বাবর ও ইমাম হোসেন যেন একই বৃত্তে দুটি কুসুম’_ মন্তব্যের সপক্ষে যুক্তি দাও।