Contents
সারসংক্ষেপঃ
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীর অধিকার নিয়ে সবসময় তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সরব হয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সমাজ এমনকি নিজ পরিবারেও নারী যে ধরনের বৈষম্যের শিকার হয় তার যুক্তিনিষ্ঠ বর্ণনা দিয়েছেন ‘গৃহ’ প্রবন্ধে। তিনি পারিবারিক জীবনে নারীর নির্মম কষ্ট আর চরম বঞ্চনার বিষয়টি নিয়েই আলোচ্য প্রবন্ধটি রচনা করেছেন।প্রবন্ধটির শুরুতেই লেখক গৃহ বা ঘর সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। তিনি ঘরকে বলেছেন শান্তি-নিকেতন, যেখানে সকল মানুষই আরাম করে, বিশ্রাম নেয়। ফলে গৃহ সকলের কাছেই নিরাপদ ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই গৃহে নারীর অধিকার কতটুকু তা তিনি বিভিন্ন দৃষ্টান্তের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় সাধারণত বলা হয়ে থাকে, নারীর জন্য বরাদ্দ ‘ঘর’, আর পুরুষের জন্য আছে ‘বাহির’। অর্থাৎ পুরুষ সম্পৃক্ত থাকবে বাইরের জীবন ও জগতের সঙ্গে। অন্যদিকে, গার্হস্থ্য ও পারিবারিক জীবনে সীমাবদ্ধ থাকবে নারী। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে পুরুষের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে; নারীকে করে তোলে ঘরের সামগ্রী। কিন্তু নারীর সত্যিই কোনো ঘর আছে কিনা— এ নিয়েই তৈরি হতে পারে প্রশ্ন; রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এ প্রশ্নটিই তুলেছেন ‘গৃহ’ প্রবন্ধে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতাসূত্রে তিনি দেখিয়েছেন পুরুষের আধিপত্য ও প্রতিপত্তির কাছে নারীর ঘরও বিপন্ন, ঘর বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু নেই । নারীর অর্থ, সম্পদ, সম্পত্তি ও জীবনযাপন – প্রায় সব কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে পুরুষ। পারিবারিকভাবে প্রাপ্ত সম্পদ ও সম্পত্তিও দখল করে নিয়েছে পুরুষ। প্রবন্ধটিতে বেশ কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে রোকেয়া দেখিয়েছেন পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ও অভিভাবকত্বে নিজস্ব গৃহের আনন্দ ও অনুভূতি থেকে নারী প্রবলভাবে বঞ্চিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গৃহ বা ঘর প্রকৃতপক্ষে মানুষের শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির স্থান।প্রবন্ধকার রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য, যুক্তিশীলতা ও প্রাগ্রসর চিন্তাশীলতার মাধ্যমে এই প্রবন্ধে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সমাজভাবনার এক চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তিনি সমাজে নারী-পুরুষের অবস্থার ব্যবধান দেখিয়ে প্রমাণ করেছেন নারী তার গৃহেও আনন্দ ও অনুভূতি থেকে বঞ্চিত। এদিক থেকে এটি তাঁর সমাজভাবনার এক অনন্য দলিল হয়ে উঠেছে।
নামকরণঃ
মূল বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে ‘গৃহ’ প্রবন্ধটির নামকরণ করা হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে গৃহে নারীর অধিকার-বঞ্চনার বাস্তবতাকে ভিত্তি করে এ প্রবন্ধটি রচিত হয়েছে বলে এর নাম ‘গৃহ’ অত্যন্ত সার্থক ও যথার্থ হয়েছে।
লেখক-পরিচিতিঃ
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জহিরউদ্দীন আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা চৌধুরী। তাঁর প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন এবং বৈবাহিক সূত্রে নাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। রোকেয়ার পিতা বহু ভাষায় সুপণ্ডিত হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। বড়ভাই-বোনের সাহচর্যে রোকেয়া বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ভালোভাবেই রপ্ত করেন এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। ১৮৯৮ সালে উর্দুভাষী ও বিপত্নীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তার জ্ঞানার্জনের পথ অধিকতর সুগম হয়। বিরূপ সমালোচনা ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মুখেও তিনি কখনই নারীশিক্ষার লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি; বরং পর্দাপ্রথা ও শিক্ষাবিমুখ মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ছাত্রী সংগ্রহ করেছেন। রোকেয়া বাংলা গদ্যের বিশিষ্ট শিল্পী। সমাজের কুসংস্কার ও জড়তা দূর করার জন্য তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও হৃদয়গ্রাহী গদ্য রচনা করেন। তাঁর সব রচনাই সমাজ জীবনের গভীর উপলব্ধি থেকে উৎসারিত। মতিচুর’ ও ‘অবরোধবাসিনী’ তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ গদ্যগ্রন্থ। এছাড়া সুলতানার স্বপ্ন ও ‘পদ্মরাগ’ নামে দুটি উপন্যাসও তিনি রচনা করেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে।
তথ্য | বিস্তারিত |
---|---|
পূর্ণ নাম | রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন |
জন্ম তারিখ | ৯ ডিসেম্বর, ১৮৮০ |
জন্মস্থান | রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রাম |
পিতার নাম | জহিরউদ্দীন আবু আলী হায়দার সাবের |
মাতার নাম | রাহাতুন্নেসা চৌধুরী |
জন্ম নাম | রোকেয়া খাতুন, বিবাহিক সূত্রে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন |
বৈবাহিক সম্পর্ক | ১৮৯৮ সালে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বিবাহ |
পেশা | ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট |
শিক্ষার অবস্থা | মুসলমান মেয়েদের জন্য শিক্ষার প্রচারে অংশগ্রহণ |
সাহিত্যিক শৈলী | বাংলা গদ্যবিদ |
প্রধান কাজ | “মতিচুর” ও “অবরোধবাসিনী” |
উপন্যাস | “সুলতানা দ্রীম” ও “পদ্মরাগ” |
সামাজিক অবদান | নারীদের শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কার প্রচারে যোগদান |
মৃত্যুর তারিখ | ৯ ডিসেম্বর, ১৯৩২ |
পাঠ-পরিচিতিঃ
প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় সাধারণত বলা হয়ে থাকে, নারীর জন্য বরাদ্দ ‘ঘর’ আর পুরুষের জন্য আছে ‘বাহির। অর্থাৎ পুরুষ সম্পৃক্ত থাকবে বাইরের জীবন ও জগতের সঙ্গে। অন্য দিকে, গার্হস্থ্য ও পারিবারিক জীবনে সীমাবদ্ধ থাকবে নারী। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে পুরুষের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে; নারীকে করে তোলে ঘরের সামগ্রী। কিন্তু নারীর সত্যিই কোনো ঘর বা গৃহ আছে কিনা- এ নিয়েই তৈরি হতে পারে প্রশ্ন; রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এ প্রশ্নটিই তুলেছেন ‘গৃহ’ প্রবন্ধে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতাসূত্রে তিনি দেখিয়েছেন পুরুষের আধিপত্য ও প্রতিপত্তির কাছে নারীর ঘরও বিপন্ন, ঘর বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু নেই। নারীর অর্থ, সম্পদ, সম্পত্তি ও জীবনযাপন- প্রায় সব কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে পুরুষ। পারিবারিকভাবে প্রাপ্ত সম্পদ ও সম্পত্তিও দখল করে নিয়েছে পুরুষ। প্রবন্ধটিতে বেশ কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে রোকেয়া দেখিয়েছেন পুরুষের নিয়ন্ত্রণ ও অভিভাবকত্বে নিজস্ব গৃহের আনন্দ ও অনুভূতি থেকে নারী প্রবলভাবে বঞ্চিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষ গৃহ বা ঘর প্রকৃতপক্ষে মানুষের শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির স্থান।
বিষয় | বিশ্লেষণ |
---|---|
সমাজব্যবস্থা | পুরুষ এবং নারীর জীবনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভূমিকা অভিন্নভাবে বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। পুরুষ সামগ্রিকভাবে বাহিরের জীবনে সংবৃত্ত থাকতে পারে, যেখানে নারীকে গার্হস্থ্য ও পারিবারিক জীবনে সীমাবদ্ধ করা হয়। |
দৃষ্টিভঙ্গি | বিশেষভাবে পুরুষ আধিপত্য এবং প্রতিপত্তির কাছে নারীর জীবন ঘরে বা বাইরে তার সম্পর্কে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। নারীর অর্থ, সম্পদ, সম্পত্তি ও জীবনযাপনে পুরুষের আধিপত্য ও প্রভাবের প্রভাবে তার জীবনের সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। |
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন | এই প্রবন্ধটিতে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন পুরুষের আধিপত্য ও প্রতিপত্তির কাছে নারীর ঘরও বিপন্ন হওয়ার প্রস্তুতি হওয়ার কথা বলেছেন। তার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর স্থান চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে এবং তার মতে নারী অধিকার এবং স্বাধীনতা অধিক বাড়াতে হবে। |
নারীর সংস্কৃতি | নারীর পুরুষকে ঘরের সামগ্রী হিসেবে বলে তার অর্থ, সম্পদ, সম্পত্তি ও জীবনযাপনে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং বিশেষভাবে পারিবারিকভাবে প্রাপ্ত সম্পদ এবং সম্পত্তিও পুরুষ দ্বারা দখল করা হয়েছে। |
শব্দার্থ ও টীকাঃ
শব্দ | শব্দার্থ ও টীকা |
---|---|
বিরাম | বিশ্রাম |
নিকেতন | বাড়ি |
শ্রান্ত | কাজ করে ক্লান্ত |
গৃহী | গৃহে বসবাসকারী |
উপাদেয় | সুস্বাদু |
বাটী | বাড়ি |
অন্তঃপুর | ভেতর বাড়ি |
কূপমণ্ডুক | স্বল্পজ্ঞানী |
যথোচিত | যথার্থ |
অসূর্যম্পশ্য | সূর্যের আলো দেখতে পায় না এমন। |
সওয়ারি | যাত্রী। এখানে গাড়িতে চড়ে যাত্রী হওয়ার দরকার পড়ে না বোঝানো হয়েছে। |
কোহবর | কল্পনার স্বর্গ (ফাঃ) |
কুক্কুট | মোরগ, মুরগি |
প্রফুল্লমুখী | আনন্দিত |
সপত্নী কণ্টক | সতীনকে এখানে কাটা বা যন্ত্রণা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। |
অধীশ্বর | মালিক |
কোদল | কোন্দল বা বিবাদের কথ্য রূপ। |
অমরাবতী | স্বর্গ |
মনোহর | মন হরণকারী |
টিপাই | ইংরেজি teapoy শব্দ থেকে এসেছে। হালকা খাবার পরিবেশনের জন্য তিন পা বিশিষ্ট ছোট টেবিল। |
বৈঠকখানা | বসার ঘর |
বিলাত | আরবি ভাষা থেকে গৃহীত শব্দ। বিদেশ, ইংল্যান্ড, ইউরোপ ইত্যাদি বোঝাতে ব্যবহৃত হয় |
নায়েব | নায়েব ফারসি শব্দ। প্রতিনিধি অর্থে ব্যবহৃত হয়। জমিদারি ব্যবস্থায় নায়েবরা জমিদারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। |
বর্ষীয়সী | বয়স্ক |
ক্রীড়াপুতুল | খেলার পুতুল |
প্রভূত | প্রচুর, অনেক |
কুলীন | উচ্চ বংশজাত |
আত্মসাৎ | অন্যায়ভাবে গ্রাস করা হয়েছে এমন |
নরাকার | মানুষ স্বরূপ |
পিশাচ | নিষ্ঠুর, লোভী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে |
ঝঞ্ঝালিন | ঝড়ের বাতাস |
বজ্রনাদ | বজ্রের শব্দ |
চপলা-চমক | বিদ্যুচ্চমক |
মেদিনী | পৃথিবী |
ত্রিতল | তিন তলা বিশিষ্ট |
অট্টালিকা | দালান |
সোপান | সিঁড়ি |
কলেবর | দেহ, শরীর |
গোশালা | গোয়ালঘর |
অমানিশীথ | অন্ধকার রাত্রি |
লঙ্কাকাণ্ড | রাম-রাবণের যুদ্ধ। এখানে ‘দুষ্টলোক কর্তৃক লঙ্কাকাণ্ডের অভিনয়’ বলতে বোঝানো হয়েছে বাজে লোকের আক্রমণ। |
শরণাপন্ন | শরণ অর্থ সাহায্য বা আশ্রয়। শরণ ও আপন্ন শব্দ দুটি যুক্ত হয়ে শরণাপন্ন, অর্থাৎ আশ্রয় বা সাহায্যপ্রার্থী। |
পর্ণকুটীর | পাতার ঘর |
নিরাশ্রয়া | আশ্রয়হীন |
কাহিনী অ্যানিমেশনঃ
মূল কাহিনীঃ
গৃহ বলিলে একটা আরাম বিরামের শান্তি-নিকেতন বুঝায়— যেখানে দিবাশেষে গৃহী কর্মক্লান্ত শ্রান্ত অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়া বিশ্রাম করিতে পারে। গৃহ গৃহীকে রৌদ্র বৃষ্টি হিম হইতে রক্ষা করে। পশু পক্ষীদেরও গৃহ আছে। তাহারাও স্ব স্ব গৃহে আপনাকে নিরাপদ মনে করে ।
পিপাসা না থাকিলে জল যেমন উপাদেয় বোধ হয় না, সম্ভবত সেইরূপ গৃহ ছাড়িয়া কতকদিন বিদেশে না থাকিলে গৃহসুখ মিষ্টি বোধ হয় না। পুরুষেরা যদিও সর্বদা বিদেশে যায় না, তবু সমস্ত দিন বাহিরে সংসারক্ষেত্রে থাকিয়া অপরাহ্নে গৃহে ফিরিয়া আসিবার জন্য উৎসুক হয়- বাড়ি আসিলে যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচে।
এখন আমাদের গৃহ সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলিতে চাই। আমাদের সামাজিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে দেখি, অধিকাংশ ভারত নারী গৃহসুখে বঞ্চিতা। যাহারা অপরের অধীনে থাকে, অভিভাবকদের বাটীকে আপন ভবন মনে করিতে যাহাদের অধিকার নাই, গৃহ তাহাদের নিকট কারাগার তুল্য বোধ হয়। পারিবারিক জীবনে যে সুখী নহে, সে নিজেকে পরিবারের একজন গণ্য বলিয়া মনে করিতে সাহসী নহে, তাহার নিকট গৃহ শান্তিনিকেতন বোধ হইতে পারে না। কুমারী, সধবা, বিধবা- সকল শ্রেণির অবলার অবস্থাই শোচনীয় । প্ৰমাণ স্বরূপ কয়েকটি অন্তঃপুরের একটু একটু নমুনা দিতেছি। এরূপে অন্তঃপুরের পর্দা উঠাইয়া ভিতরের দৃশ্য দেখাইলে আমার ভ্রাতৃগণ অত্যন্ত ব্যথিত হইবেন, সন্দেহ নাই ।
আমরা একবার (বেহারে) জামালপুরের নিকটবর্তী কোন শহরে বেড়াইতে গিয়াছিলাম। সেখানে আমাদের জনৈক বন্ধুর বাড়ি আছে। সে বাটীর পুরুষের সহিত আমাদের আত্মীয় পুরুষদের বন্ধুত্ব আছে বলিয়া শরাফত উকিলের বাড়ীর স্ত্রীলোদিগকে দেখিতে আমাদের আগ্রহ হয়। দেখিলাম, মহিলা কয়টি অতিশয় শান্ত শিষ্ট মিষ্টভাষিণী, যদিও কূপমণ্ডূক! তাঁহারা আমাদের যথোচিত অভ্যর্থনা করিলেন। সেখানে শরাফতের পত্নী হসিনা,ভগ্নী জমিলা, জমিলার কন্যা ও পুত্রবধূ প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন। অতঃপর জমিলাকে যখন আমাদের বাসায় যাইতে অনুরোধ করিলাম, তখন তিনি বলিলেন যে তাঁহারা কোন কালে বাড়ির বাহির হন না, ইহাই তাঁহাদের বংশগৌরব। কখনও ঘোড়ার গাড়ি বা অন্য কোন যানবাহনে আরোহণ করেন নাই। আমি সবিস্ময়ে বলিলাম, “তবে আপনারা বিবাহ করিয়া শ্বশুরবাড়ি যান কিরূপে? আপনার ভ্রাতৃবধূ আসিলেন কি করিয়া?” জমিলা উত্তর দিলেন, “ইনি আমাদের আত্মীয়-কন্যা- এ পাড়ায় কেবল আমাদেরই গোষ্ঠীর বাড়ি পাশাপাশি দেখিবে।” এই বলিয়া তিনি আমাকে অন্য একটা ঘরে লইয়া গিয়া বলিলেন, “এই আমার কন্যার বাড়ি; এখন আমার বাড়ি চল।” তিনি আমাকে একটা অপ্রশস্ত গলির ভিতর দিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া লইয়া গেলেন। তাঁহার সকলগুলি কক্ষ দেখাইলেন। কক্ষগুলি “অসূৰ্য্যম্পশ্য” বলিয়া বোধ হইল। অতঃপর একটি দ্বার খুলিলে দেখিলাম অপরদিকে হসিনার পুত্রবধূ আছে! – জমিলা বলিলেন, “দেখিলে এই দ্বারের ওপার্শ্বে আমার ভাইয়ের বাড়ি, এপার্শ্বে আমার বাড়ি। ও কক্ষে বধূ থাকেন বলিয়া এ দ্বারটি বন্ধ রাখি। আমাদের সওয়ারির দরকার হয় না কেন, তাহা এখন বুঝিলে?” ঐরূপে সকল বাড়িই প্রদক্ষিণ করা যায়।
পাঠিকা কি মনে করেন যে হসিনা বা জমিলা গৃহে আছেন? অবশ্য না; কেবল চারি প্রাচীরের ভিতর থাকিলেই গৃহে থাকা হয় না । এদেশে বাসরঘরকে “কোর” বলে, কিন্তু “কবর” বলা উচিত!! বাড়িখানা ত শরাফতের, সেখানে যেমন এক পাল ছাগল আছে, হংস কুক্কুট আছে, সেইরূপ একদল স্ত্রীলোকও আছেন! অথবা স্ত্রীলোকদের “বন্দিনী” বলা যাইতে পারে ! সাধারণত পরিবারের প্রধান পুরুষটি মনে করেন গৃহখানা কেবল “আমার বাটী”- পরিবারস্থ অন্যান্য লোকেরা তাঁহার আশ্রিতা। মালদহে কয়েকবার আমরা এক বাটীতে যাতায়াত করিয়াছি। গৃহস্বামী কলিমের স্ত্রীকে আমরা কখনও প্রফুল্লমুখী দেখি নাই । তাঁহার ম্লান মুখখানি নীরবে আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি আকর্ষণ করিত । ইহার কারণ এই— কয় বৎসর অতীত হইল, কলিম স্বীয় ভায়রা ভাইয়ের সহিত বিবাদ করিয়াছেন; তাহার ফলে কলিমের পত্নী স্বীয় ভগ্নীর সহিত দেখা করিতে পান না! তিনি এতটুকু ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া বলিতে পারেন না, “আমার ভগ্নী আমার নিকট অবশ্য আসিবেন।” হায়! বাটী যে কলিমের! তিনি যাহাকে ইচ্ছা আসিতে দিবেন, যাহাকে ইচ্ছা আসিতে দিবেন না! আবার ওদিকে ও বাটীখানা সলিমের! সেখানে কলিমের পত্নীর প্রবেশ নিষেধ !
বলা বাহুল্য কলিমের স্ত্রীর অন্ন, বস্ত্র বা অলংকারের অভাব নাই। বলি, অলংকার কি পিতৃমাতৃহীনা অবলার একমাত্র ভগ্নীর বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা ভুলাইতে পারে? শুনিলাম, তিনি সপত্নী-কণ্টক হইতেও বিমুক্ত নহে! এরূপ অবস্থায় তাঁহার নিকট গৃহ কি শান্তিনিকেতন বলিয়া বোধ হয়?
আমরা রমাসুন্দরীকে অনেকদিন হইতে জানি । তিনি বিধবা; সন্তান সন্ততিও নাই । তাঁহার স্বামীর প্রভূত সম্পত্তি আছে, দুই চারিটি পাকা বাড়িও আছে। তাঁহার দেবর এখন সে সকল সম্পত্তির অধীশ্বর। দেবরটি কিন্তু রমাকে একমুঠা অন্ন এবং আশ্রয়দানেও কুণ্ঠিত। আমরা বলিলাম, “ইনি হয়ত দেবর-পত্নীর সহিত কোঁদল করেন।” এ কথার উত্তরে একজন বলিলেন, “রমা সব করিতে জানে, কেবল কোঁদল জানে না। রমা বেশ জানে, কি করিয়া পরকে আপন করিতে হয়; কেবল আপনাকে পর করিতে জানে না।”
“এত গুণ সত্ত্বেও দেবরের বাড়ি থাকিতে পান না কেন?”
“কপালের দোষ!”
আমরা একটি রাজবাড়ি দেখিতে গিয়াছিলাম। বাড়িখানি কবি-বর্ণিত অমরাবতীর ন্যায় মনোহর। বৈঠকখানা বিবিধ মূল্যবান সাজসজ্জায় ঝলমল করিতেছে; এদিকে সেদিকে ৫/৭ খানা রজত-আসন শূন্য হৃদয়ে রাজাকে আহ্বান করিতেছে!
রাণীর ঘর কয়খানাতেও টেবিল, টিপাই, চেয়ার ইত্যাদি সাজসজ্জা আছে। কিন্তু তাহার উপর ধূলার স্তর পড়িয়াছে । রাজা কোন কালে এসব কক্ষে পদার্পণ করেন বলিয়া বোধ হইল না ৷
রাণীকে দেখিয়া আমি হতাশ হইলাম । কারণ বৈঠকখানা দেখিয়া আমি রাণীর যেরূপ মূর্তি কল্পনা করিয়াছিলাম, এ মূর্তি তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি পরমা সুন্দরী বালিকা – পরিধানে সামান্য লালপেড়ে বিলাতি ধুতি; মাথায় রুক্ষ কেশের জটা— অনুমান পনের দিন হইতে তৈলের সহিত চুলগুলির সাক্ষাৎ হয় নাই, মুখখানি এমনই করুণ ভাবে পূর্ণ যে রাণীকে মূর্তিমতী “বিষাদ” বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অনেকের মতে চক্ষু মনের দর্পণ স্বরূপ । রাণীর নয়ন দু’টিতে কি কি হৃদয়বিদারক ভাব ছিল, তাহা আমি বর্ণনা করিতে অক্ষম।
আমাদের একটি বর্ষীয়সী সঙ্গিনী বলিলেন, “তুমি রাজার রাণী, তোমার এ বেশ কেন? এস আমি চুল বেঁধে দিই।” রাণী উত্তর দিলেন, “জানি না কি পাপে রাণী হয়েছি!” ঠিক কথা! অথচ লোকে এই রাণীর পদ কেমন বাঞ্ছনীয় বোধ করে!
“মহম্মদীয় আইন” অনুসারে আমরা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হই— “আমাদের বাড়ি”ও হয়। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়, – বাড়ির প্রকৃত কর্তা স্বামী, পুত্র, জামাতা, দেবর ইত্যাদি হন। তাঁহাদের অভাবে বড় আমলা বা নায়েবটি বাড়ির মালিক! গৃহকর্ত্রীটি ঐ নায়েবের ক্রীড়াপুতুল মাত্র। নায়েব কর্ত্রীকে যাহা বুঝায়, অবোধ নিরক্ষর কর্ত্রী তাহাই বুঝেন।
ঐরূপ আরও কত উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। খদিজা প্রভূত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী, তাঁহার স্বামী হাশেম দরিদ্র কিন্তু কুলীন বিদ্বান। হাশেম ছলে কৌশলে সমস্ত জমিজমা আত্মসাৎ করিয়া লইলেন; খদিজার হাতে এক পয়সা নাই। খদিজার পৈত্রিক বাড়িতে বসিয়াই হাশেম আর দুই তিনটা বিবাহ (?) করিয়া তাঁহাকে সতিনী জ্বালায় দগ্ধ করিতে লাগিলেন! এরূপ না করিলে আর ক্ষমতাশালী পুরুষের বাহাদুরি কি? ইহাতে যদি খদিজা সামান্য বিরক্তি প্রকাশ করেন, তবে প্রবীণা মহিলাগণ তাঁহার হৃদয়ে স্বামীভক্তির অভাব দেখিয়া নিন্দা করেন ।
আমার এই প্রবন্ধ পাঠ করিয়া ভ্রাতা ভগ্নীগণ হয়ত মনে করিবেন যে আমি কেবল ভ্রাতৃবৃন্দকে নরাকারে পিশাচরূপে অঙ্কিত করিবার জন্যই কলম ধরিয়াছি। তাহা নয়। আমি ত কোথাও ভ্রাতাদের প্রতি কটু শব্দ ব্যবহার করি নাই- কাহাকেও পাপিষ্ঠ, পিশাচ, নিষ্ঠুর বলিয়াছি কি? কেবল রমণীহৃদয়ের ক্ষত দেখাইয়াছি। ঐ যে কথায় বলে, “বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়”, এক্ষেত্রে তাহাই হইয়াছে— ভগ্নীর দুঃখ বর্ণনা করিতে ভ্রাতৃনিন্দা হইয়া পড়িয়াছে ।
সুখের বিষয় আমাদের অনেক ভ্রাতা এরূপ আছেন, যাঁহারা স্ত্রীলোকদিগকে যথেষ্ট শান্তিতে গৃহসুখে রাখেন । কিন্তু দুঃখের সহিত আমরা ইহাও বলিতে বাধ্য যে অনেক ভ্রাতা আপন আপন বাটীতে অন্যায় স্বামীত্বের পরিচয় দিয়া থাকেন ।
যখন আমাদের চালের উপর খড় থাকে না, দরিদ্রের জীর্ণতম কুটিরের শেষ চালখানা ঝঞ্ঝানিলে উড়িয়া যায়, – টুপ-টাপ বৃষ্টিধারায় আমরা সমস্ত রাত্রি ভিজিতে থাকি, – চপলা-চমকে নয়নে ধাঁধা লাগে, – বজ্ৰনাদে মেদিনী কাঁপে, এবং আমাদের বুক কাঁপে- প্রতি মুহূর্তে ভাবি, বুঝি বজ্রপাতে মারা যাই— তখনও আমরা অভিভাবকের বাটীতেই থাকি!
যখন আমরা রাজকন্যা, রাজবধূরূপে প্রাসাদে থাকি, তখনও প্রভু-গৃহে থাকি। আবার যখন ঐ প্রাসাদতুল্য ত্রিতল অট্টালিকা ভূমিকম্পে চূর্ণ হয়, – সোপান অতিক্রম করিয়া অবতরণ কালে আমাদের মাথা ভাঙ্গে, হাত পা ভাঙ্গে— রক্তাক্ত কলেবরে হতজ্ঞান প্রায় অবস্থায় গোশালায় গিয়া আশ্রয় লই, তখনও অভিভাবকদের বাটীতে থাকি!!
অথবা গৃহস্থের বৌ-ঝি রূপে প্রকাণ্ড আটচালায় বাস করিলেও প্রভুর আলয়ে থাকি; আর যখন চৈত্র মাসে ঘোর অমানিশীথে প্রভুর বাটীতে দুষ্টুলোক কর্তৃক লঙ্কাকাণ্ডের অভিনয় হয়, —সব জিনিসপত্রসহ ঘরগুলি দাউদাউ করিয়া জ্বলিতে থাকে, – আমরা একবসনে প্রাণটি হাতে করিয়া কোনমতে দৌড়াইয়া গিয়া দূরস্থিত একটা কূলগাছতলে দাঁড়াইয়া কাঁপিতে থাকি, তখনও অভিভাবকের বাটীতে থাকি!!!
ইংরেজিতে (Home) বলিতে যাহা বুঝায়, “গৃহ” শব্দ দ্বারা আমি তাহাই বুঝাইতে চাই । শারীরিক আরাম ও মানসিক শান্তিনিকেতন যাহা, তাহাই গৃহ। বিধবা হইলে স্বামীগৃহ একরূপ বাসের অযোগ্য হয়; হতভাগিনী তখন পিতা, ভ্রাতার শরণাপন্ন হয়। একটা হিন্দি প্রবাদ আছে:
“ঘর কি জ্বলি বনমে গেয়ী-বনমে লাগি আগ
বন বেচারা কিয়া করে,- করমঁমে লাগি আগ!”
অর্থাৎ “গৃহে দগ্ধ হইয়া বনে গেলাম, বনে লাগিল আগুন; বন বেচারা কি করিবে, (আমার) কপালেই লাগিয়াছে আগুন।”
তাই বলি, গৃহ বলিতে আমাদেরই একটি পর্ণকুটীর নাই । প্রাণি-জগতে কোন জন্তুই আমাদের মত নিরাশ্রয়া নহে । সকলেরই গৃহ আছে— নাই কেবল আমাদের।
বহুনির্বাচনি প্রশ্নঃ
১। গৃহ’ রচনায় প্রাবন্ধিক কাদেরকে ‘কূপমন্ডুক বলেছেন?
ক. পুরুষদের
খ. মহিলাদের
গ. সমাজপতিদের
ঘ. রাজাদের
২। সকলেরই গৃহ আছে- নাই কেবল আমাদের প্রাবন্ধিকের একথা বলার কারণ কী?
ক. দরিদ্রতা।
খ. অধিকারহীনতা
গ. গৃহবিমুখতা
ঘ. গৃহ ভস্মীভূত হওয়া।
উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও।
দিশাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে সম্রান্ত ঘরে। সুশিক্ষিত দিশা স্বামী-সংসারে স্বাধীনভাবে বসবাস করছেন। চাকরির পাশাপাশি ঘরকন্নার কাজও করেন। সব কাজে-কর্মে সবাই সহযোগিতা করেন সবাই তাকে ভালোবাসেন। তিনিও আত্মনির্ভরশীল ও পরিতৃপ্ত।
৩। উদ্দীপকের দিশার মধ্যে গৃহ’ প্রবন্ধের কোন্ দিকটি অনুপস্থিত?
ক. স্বকীয়তা
খ. স্বাধীনতা
গ. অভাবগ্রস্থতা
ঘ. পুরুষ-আধিপত্য
৪। উক্ত বৈশিষ্ট্যটি নিচের যে বাক্যে পাওয়া যায়-
i. অধিকাংশ ভারত-নারী গৃহ সুখে বঞ্চিত।
ii. প্রকাণ্ড আটচালায় বাস করিলেও প্রভুর আলয়ে থাকি
iii. অনেক ভ্রাতা আপন আপন বাটীতে অন্যায় স্বামীত্বের পরিচয় দিয়া থাকেন।
নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্নঃ
দাও হেন বর সাগরের মত
গম্ভীর যার বাণী,
আন্-ভুবনের অজানা সুরভি
পরানে মিলাবে আনি,
দাও হেন স্বামী যে আমার পানে
চাহিবে সহজ সুখে,
যে চোখে শ্যামল প্রান্তর চায়
উষার অরুণ মুখে,
ক. অনেকের মতে চক্ষু কীসের দর্পণ?
খ. বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়- একথা বলার কারণ কী?
গ. উদ্দীপকের সাথে ‘গৃহ’ রচনার বৈসাদৃশ্যপূর্ণ দিকটি ব্যাখ্যা কর।
ঘ. উদ্দীপকটি যেন প্রাবন্ধিকের মূল চাওয়া- মন্তব্যটির যথার্থতা বিচার কর।