তামিম আহমেদ
তামিম আহমেদ
15 Mar 2024 (2 months ago)
আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, বাংলাদেশ

বাংলা বানানের নিয়ম | বাংলা ২য় পত্র ব্যাকরণ | একাদশ-দ্বাদশ | এইচএসসি (HSC)


Listen to this article

Contents

উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত বাংলা বানানের লিখিত নিয়ম বলতে কিছু ছিল না। বাংলা ভাষার বানান প্রমিত করার চেষ্টা দেখা যায় উনিশ শতকের প্রথমার্ধে। তখন তৎসম শব্দের বানান নির্দিষ্ট করা হয় সংস্কৃত অভিধান অনুযায়ী। কিন্তু অতৎসম শব্দের ক্ষেত্রে কোনো দিক-নির্দেশনা না থাকায় এসব শব্দের ক্ষেত্রে কোনোরূপ শৃঙ্খলা বিধান করা যায় নি। বিশ শতকের সূচনা থেকে বাংলা লেখায় অর্ধতৎসম ও তদ্ভব শব্দের ব্যবহার ক্রমশ বাড়তে থাকায় এসব শব্দের বানান সুনির্ধারিত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। বাঙলা ভাষায় সংস্কৃত (তৎসম) শব্দ ছাড়াও অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ভাষার অসংখ্য শব্দ রয়েছে। এছাড়া রয়েছে উপসর্গ, সমাস, প্রত্যয়, বিভক্তিযোগে গঠিত নানা ধরনের মিশ্র শব্দ। আধুনিক যুগে চলিতরীতির ব্যাপক সম্প্রসারণের ফলেও বানানের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটছে। এমতাবস্থায় বানান সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়েছে।

তৎসম শব্দ ও অতৎসম শব্দঃ

তৎসম শব্দ

১. এই নিয়মে বর্ণিত ব্যতিক্রম ছাড়া তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের নির্দিষ্ট বানান অপরিবর্তিত থাকবে।

২. যেসব তৎসম শব্দে ই ঈ বা উ ঊ উভয় শুদ্ধ কেবল সেসব শব্দে যথাক্রমে ই বা উ এবং তার কার চিহ্ন ( ি) হবে। যেমন কিংবদন্তি, খঞ্জনি, চিৎকার, চুল্লি, তরণি, ধমনি, ধরণি, শ্রেণি, সরণি, সূচিপত্র, উর্ণা, উষা। নাড়ি, পঞ্জি, পদবি, পল্লি, ভঙ্গি, মঞ্জরি, মসি, যুবতি, রচনাবলি, লহরি।

৩. রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন- অর্জন, ঊর্দ্ধ, কৰ্ম্ম, কার্ত্তিক, কার্য্য, বার্দ্ধক্য, মূর্ছা, সূর্য্য ইত্যাদির পরিবর্তে যথাক্রমে- অর্জন, ঊর্ধ্ব, কর্ম, কার্তিক, কার্য, বার্ধক্য, মূর্ছা, সূর্য ইত্যাদি হবে।

৪. সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পূর্ব পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার (ং) হবে। যেমন- অহম্ + কার = অহংকার । এভাবে ভয়ংকর, অলংকার, সংগীত, শুভংকর, হৃদয়ংগম, সংঘটন । সন্ধিবদ্ধ না হলে ঙ স্থানে হবে না। যেমন- অঙ্ক, অঙ্গ, আকাঙ্ক্ষা, আতঙ্ক, কঙ্কাল, গঙ্গা, বঙ্কিম, বঙ্গ, লঙ্ঘন, শঙ্কা, শৃঙ্খলা, সঙ্গে, সঙ্গী।

৫. সংস্কৃত ইন্‌-প্রত্যয়ান্ত শব্দের দীর্ঘ ঈ-কারান্ত রূপ সমাসবদ্ধ হলে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী সেগুলোতে হ্রস্ব ই-কার হয়।

যেমন- গুণী → গুণিজন, প্রাণী প্রাণিবিদ্যা, মন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ, মন্ত্রিসভা।

তবে এগুলোর সমাসবদ্ধ রূপে ঈ-কারের ব্যবহারও চলতে পারে। যেমন- গুণী গুণীজন, প্রাণী প্রাণীবিদ্যা।

ইন্‌-প্রত্যয়ান্ত শব্দের সঙ্গে ত্ব ও তা প্রত্যয় যুক্ত হলে ই-কার হবে। যেমন- দায়ী দায়িত্ব, মন্ত্রী মন্ত্রিত্ব, সহযোগী সহযোগিতা।

৬. বিসর্গ: শব্দের শেষে বিসর্গ থাকবে না। যেমন- ইতস্তত, কার্যত, ক্রমশ, পুনঃপুন, প্রথমত, প্রধানত, প্রয়াত, প্রায়শ, ফলত, বস্তুত, মূলত।

এছাড়া নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে শব্দমধ্যস্থ বিসর্গ-বর্জিত রূপ গৃহীত হবে। যেমন- দুস্থ, নিস্তব্ধ, নিস্পৃহ, নিশ্বাস।

অতৎসম শব্দ

১. ই, ঈ, উ, ঊ: সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ও মিশ্র শব্দে প্রযোজ্যমতে কেবল ই, উ এবং এদের কার চিহ্ন কি ব্যবহৃত হবে। যেমন- আরবি, আসামি, ইংরেজি, ইমান, ইরানি, উনিশ, ওকালতি, কাহিনি, কুমির, কেরামতি, খুশি, খেয়ালি, গাড়ি, গোয়ালিনি, চাচি, জমিদারি, জাপানি, জার্মানি, টুপি, তরকারি, দাড়ি, দাদি, দাবি, দিঘি, দিদি, নানি, নিচু, পশমি, পাখি, পাগলামি, পাগলি, পিসি, ফরাসি, ফরিয়াদি, ফারসি, ফিরিঙ্গি, বর্ণালি, বাঁশি, বাঙালি, বাড়ি, বিবি, বুড়ি, বেআইনি, বেশি, বোমাবাজি, ভারি (অত্যন্ত অর্থে), মামি, মালি, মাসি, মাস্টারি, রানি, রুপালি, রেশমি, শাড়ি, সরকারি, সিন্ধি, সোনালি, হাতি, হিজরি, হিন্দি, হেঁয়ালি।

চুন, পুজো, পুব, মুলা, মুলো। পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে। যেমন- ছেলেটি, বইটি, লোকটি।

সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়া-বিশেষণ ও যোজক পদরূপে কী শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন- এটা কী বই? কী আনন্দ! কী আর বলব? কী করছ? কী করে যাব?

কীভাবে, কীরকম, কীরূপে প্রভৃতি শব্দেও ঈ-কার হবে। যেসব প্রশ্নবাচক বাক্যের উত্তর হ্যাঁ বা না হবে, সেইসব বাক্যে ব্যবহৃত ‘কি’ হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন- তুমি কি যাবে? সে কি এসেছিল?

২. এ, অ্যা: বাংলায় ‘এ’ বর্ণ দিয়ে এ এবং অ্যা এই উভয় ধ্বনি নির্দেশিত হয়। যেমন- কেন, কেনো (ক্রয় করো); খেলা, খেলি; গেল, গেলে, গেছে; দেখা, দেখি; জেনো, যেন তবে কিছু তদ্ভব এবং বিশেষভাবে দেশি শব্দ রয়েছে যেগুলোর য-ফলা এবং আ-কার যুক্ত রূপ বহুল পরিচিত। যেমন- ব্যাঙ, ল্যাঠা। এসব শব্দে য-ফলা অপরিবর্তিত থাকবে।

বিদেশি শব্দে ক্ষেত্র-অনুযায়ী অ্যা বাা-কার ব্যবহৃত হবে। যেমন- অ্যাকাউন্ট, অ্যান্ড (and), অ্যাসিড, ক্যাসেট, ব্যাংক, ভ্যাট, ম্যানেজার, হ্যাট

৩. ওঃ বাংলা অ-ধ্বনির উচ্চারণ বহু ক্ষেত্রে ও-র মতো হয়। শব্দ শেষের এসব অ-ধ্বনি ও-কার দিয়ে লেখা যেতে পারে। যেমন- কালো, খাটো, ছোটো, ভালো; এগারো, বারো, তেরো, পনেরো, ষোলো, সতেরো

ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় শব্দের আদিতেও ও-কার লেখা যেতে পারে। যেমন- কোরো, বোলো, বোসো

৪. ৬,০ং শব্দের শেষে প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে সাধারণভাবে অনুস্বার ব্যবহৃত হবে। যেমন- গাং, টং, পালং, রং, রাং, সং। তবে অনুস্বারের সঙ্গে স্বর যুক্ত হলেও হবে। যেমন- বাঙালি, ভাঙা, রঙিন, রঙের। বাংলা ও বাংলাদেশ শব্দে অনুস্বার থাকবে।

৫. ক্ষ, খ অতৎসম শব্দ খিদে, খুদ, খুদে, খুর (গবাদি পশুর পায়ের শেষ প্রাপ্ত), খেত, খ্যাপা ইত্যাদি লেখা হবে।

৬. জ, য বাংলায় প্রচলিত বিদেশি শব্দ সাধারণভাবে বাংলা ভাষার ধ্বনিপদ্ধতি অনুযায়ী লিখতে হবে। যেমন- জাদু, জাহাজ, জুলুম, জেব্রা, বাজার, হাজার

ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কয়েকটি শব্দে বিকল্পে ‘য’ লেখা যেতে পারে। যেমন- আযান, কাযা, নামায, মুয়াযযিন, যোহর, রমযান, হযরত

৭. মূর্ধন্য ণ, দন্ত্য ন অতৎসম শব্দের বানানে ণ ব্যবহার করা হবে না। যেমন- অঘ্রান, ইরান, কান, কোরান, গভর্নর, শুনতি, গোনা, ঝরনা, ধরন, পরান, রানি, সোনা, হর্ন। তৎসম শব্দে ট ঠ ড ঢ-য়ের পূর্বে যুক্ত নাসিক্যবর্ণ ণ হয়। যেমন- কণ্টক, প্রচণ্ড, লুণ্ঠন। কিন্তু অতৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ট ঠ ড ঢ-য়ের আগে কেবল ন হবে। যেমন- গুন্ডা, ঝান্ডা, ঠান্ডা, ডান্ডা, লণ্ঠন

৮. শ, ষ, স বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে ‘ষ’ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। যেমন- কিশমিশ, নাশতা, পোশাক, বেহেশত, শখ, শয়তান, শরবত, শরম, শহর, শামিয়ানা, শার্ট, শৌখিন আপস, জিনিস, মসলা, সন, সাদা, সাল (বৎসর), স্মার্ট, হিসাব: স্টল, স্টিমার, স্ট্রিট, স্টুডিয়ো স্টেশন, স্টোর ইসলাম, তসলিম, মুসলমান, মুসলিম, সালাত, সালাম; এশা, শাওয়াল (হিজরি মাস), শাবান (হিজরি মাস)। ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশি ধ্বনির জন্য স এবং sh, sion, ssion, tion প্রভৃতি বর্ণগুচ্ছ বা ধ্বনির জন্য শ ব্যবহৃত হবে।

যেমনঃ পাসপোর্ট, বাস: ক্যাশ টেলিভিশন মিশন, সেশন রেশন, স্টেশন, স্টাইল

৯. বিদেশি শব্দ ও যুক্তবর্ণ বাংলায় বিদেশি শব্দের আদিতে বর্ণবিশ্লেষ সম্ভব নয়। এগুলো যুক্তবর্ণ দিয়ে লিখতে হবে। যেমন স্টেশন, স্ট্রিট, স্প্রিং তবে অন্য ক্ষেত্রে বিশ্লেষ করা যায়। যেমন- মার্কস, শেকসপিয়র, ইসরাফিল

১০. হস-চিহ্ন : হস-চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন- কলকল, করলেন, কাত, চট, চেক, জজ, ঝরঝর, টক, টন, টাক, ডিশ, তছনছ, ফটফট, বললেন, শখ, হুক তবে যদি অর্থবিভ্রান্তি বা ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা থাকে তাহলে হস-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- উহ্, যাহ্

১১. ঊর্ধ্ব-কমা : ঊর্ধ্ব-কমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন- বলে (বলিয়া), হয়ে, দুজন, চাল (চাউল), আল (আইল)

বিবিধঃ

১। সমাসবদ্ধ শব্দগুলো যথাসম্ভব একসঙ্গে লিখতে হবে। যেমন- অদৃষ্টপূর্ব, অনাস্বাদিতপূর্ব, নেশাগ্রস্ত, পিতাপুত্র, পূর্বপরিচিত, বিষাদমণ্ডিত, মঙ্গলবার, রবিবার, লক্ষ্যভ্রষ্ট, সংবাদপত্র, সংযতবাক, সমস্যাপূর্ণ, স্বভাবগতভাবে ।

বিশেষ প্রয়োজনে সমাসবদ্ধ শব্দটিকে এক বা একাধিক হাইফেন (-) দিয়ে যুক্ত করা যায়। যেমন- কিছু-না-কিছু, জল-স্থল, আকাশ, বাপ-বেটা, বেটা-বেটি, মা-ছেলে, মা-মেয়ে

২। বিশেষণ পদ সাধারণভাবে পরবর্তী পদের সঙ্গে যুক্ত হবে না। যেমন- ভালো দিন, লাল গোলাপ, সুগন্ধ ফুল, সুনীল আকাশ, সুন্দরী মেয়ে, স্তব্ধ মধ্যাহ্ন ।

৩। এছাড়া শব্দের পূর্বে না-বাচক উপসর্গ ‘না’ উত্তরপদের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। যেমন- নাবালক, নারাজ, নাহক। অর্থ পরিস্ফুট করার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুভূত হলে না-এর পর হাইফেন ব্যবহার করা যায়। যেমন- না-গোনা পাখি, না-বলা বাণী, না- শোনা কথা।

৪। অধিকন্তু অর্থে ব্যবহৃত ‘ও’ প্রত্যয় শব্দের কার-চিহ্ন রূপে যুক্ত না হয়ে পূর্ণ রূপে শব্দের পরে যুক্ত হবে। যেমন- আজও, আমারও, কালও, তোমারও।

৫। নিশ্চয়ার্থক ‘ই’ শব্দের সঙ্গে কার-চিহ্ন রূপে যুক্ত না হয়ে পূর্ণ রূপে শব্দের পরে যুক্ত হবে। যেমন- আজই, এখনই।

ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার নামঃ

ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার নাম এই নিয়মের আওতাভুক্ত নয়।

ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধানঃ

ণত্ব বিধান

তৎসম শব্দের বানানে মূর্ধন্য-ণ এর সঠিক ব্যবহারের নিয়মই ণত্ব বিধান।
(১) বাংলা ভাষায় সাধারণত মূর্ধন্য-ণ ধ্বনির ব্যবহার নেই ।
(২) বাংলা তদ্ভব ও দেশি শব্দের বানানে মূর্ধন্য-ণ লেখার প্রয়োজন হয় না।

মূর্ধন্য-ণ ব্যবহারের নিয়মঃ

(১) ট বর্গীয় ধ্বনির আগে তৎসম শব্দে সবসময় মূর্ধন্য-ণ যুক্ত হয়। যেমন- ঘণ্টা, লণ্ঠন, কাণ্ড ইত্যাদি।
(২) ঋ, র ও ষ – এরপরে মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন- ঋণ, তৃণ, বর্ণ, বর্ণনা ইত্যাদি।

যেসব শব্দগুলোতে স্বভাবতই মূর্ধন্য-ণ হয়ঃ
চাণক্য, মাণিক্য, গণ বাণিজ্য, লবণ, মণ বেণু, বীণা, কঙ্কণ, কণিকা, কল্যাণ, শোণিত, মণি, স্থাণু, গুণ, পুণ্য বেণী, ফণী, অণু, বিপণী গণিকা, আপণ, লাবণ্য, বাণী, নিপুণ, ভণিতা, পাণি, গৌণ, কোণ, ভাণ, পণ, শাণ, চিক্কণ, নিক্কণ, তৃণ, কফোণি, বণিক, গুণ, গণণা, পিণাক, পণ্য, বাণ।

মনে রাখবেঃ

(১) সমাসবদ্ধ শব্দে সাধারণত ণত্ব বিধান খাটে না। যেমন- ত্রিনয়ন, সর্বনাম, দুর্নীতি, দুর্নাম, দুর্নিবার, পরনিন্দা, অগ্রনায়ক।
(২) ত-বর্গীয় বর্ণের সঙ্গে যুক্ত ন কখনো মূর্ধন্য ণ হয় না, ন হয়। যেমন- অন্ত, ক্রন্দন, গ্রন্থ।


ষত্ব বিধান

তৎসম শব্দের বানানে মূর্ধন্য-ষ এর সঠিক ব্যবহারের নিয়মই ষত্ব বিধান।

  • (১) বাংলা ভাষায় সাধারণত মূর্ধন্য-ষ ধ্বনির ব্যবহার নেই ।
  • (২) বাংলা, তদ্ভব ও দেশি শব্দের বানানে মূর্ধন্য-ষ লেখার প্রয়োজন হয় না।

মূর্ধন্য-ষ ব্যবহারের নিয়মঃ

  • (১) অ, আ ভিন্ন অন্য স্বরধ্বনি এবং ক ওর এর-পরে প্রত্যয়ের স মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন- ভবিষ্যৎ, মুমূর্ষু, চক্ষুষ্মান ইত্যাদি ।
  • (২) ই-কারান্ত ও উ-কারান্ত উপসর্গের পর কতগুলো ধাতুতে “ষ” হয়। যেমন- অভিসেক > অভিষেক, সুসুপ্ত > সুষুপ্ত, অনুসঙ্গ অনুষঙ্গ, প্রতিসেধক > প্রতিষেধক।
  • (৩) ঋ এবং ঋ-কারের পর স্বভাবতই “ষ” হয়। যেমন- ঋষি, কৃষক, উৎকৃষ্ট, দৃষ্টি, সৃষ্টি ইত্যাদি।
  • (৪) ট বর্গীয় ধ্বনির সঙ্গে “ষ”যুক্ত হয়। যেমন- কষ্ট, স্পষ্ট, নষ্ট ইত্যাদি।

যেসব শব্দগুলোতে স্বভাবতই মূর্ধন্য-ষ হয়ঃ

ষড়ঋতু, রোষ, কোষ, আষাঢ়, ভাষণ, ভাষা, ষড়যন্ত্র, নিষ্কর, পাষাণ, ষোড়শ ইত্যাদি।

মনে রাখবেঃ

(১) আরবি, ফার্সি, ইংরেজি ইত্যাদি বিদেশী ভাষা থেকে আগত শব্দে “মূর্ধন্য-ষ” হয় না। যেমন- জিনিস, পোশাক, মাস্টার, টেক্স, পুলিশ, মিসর, গ্রিস, স্টেশন, মুসাবিদা ইত্যাদি।

(২) সংস্কৃত সাৎ প্রত্যয়যুক্ত পদে মূর্ধন্য-ষ হয় না। যেমন- অগ্নিসাৎ, ধুলিসাৎ, ভূমিসাৎ ইত্যাদি।

কতিপয় শব্দের নিম্নরেখ অংশের বানানের নিয়ম লেখোঃ

১. কুমির: মূল সংস্কৃত শব্দে ‘ঈ’-কার থাকলে তদ্ভব শব্দে তা পরিবর্তিত হয়ে ‘ই’-কার হয়। (কুম্ভীর > কুমীর > কুমির)।

২. বিজয়িনী: (বিজয়ী + নী = বিজয়িনী)। প্রত্যয়ের নিয়মে এখানে ‘নী’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে পদান্তের ‘ঈ’-কার ‘ই’-কারে রূপান্তরিত হয়েছে।

৩. সবুজ: ফারসি শব্দ বানানের রীতি অনুসারে বিদেশি শব্দে উচ্চারণ অনুযায়ী দন্ত্য ‘স’ বা তালব্য ‘শ’ হয়। এখানে দন্ত্য ‘স’ হয়েছে।

৪. খাটো: উচ্চারণের তারতম্যের কারণে অনেক সময় অর্থের পরিবর্তন হয়। এরকম অর্থগত পরিবর্তন যাতে না হয়, সেজন্যে অনেক সময় শব্দের শেষে ‘ও’-কার যোগ হয়। এখানে ‘খাট’ শব্দের সাথে পার্থক্য বোঝাতে ‘ও’-কার যুক্ত হয়েছে।

৫. সুতো: পূর্ববর্তী ‘উ’ কারের প্রভাবে আকার চলতি ভাষায় ‘ও’-কারে পরিবর্তিত হয়েছে।

৬. দৈশিক: (দেশ + ইক) = দৈশিক। প্রত্যয়ের নিয়মে এখানে ‘ইক’ প্রত্যয় যুক্ত হওয়াকে আদি স্বরের বৃদ্ধি হয়েছে। অর্থাৎ ‘এ’-কার পরিবর্তিত হয়ে ‘ঐ’-কার হয়েছে।

৭. লেখক: (লিখ + অক = লেখক)। প্রত্যয়ের নিয়মে এখানে ‘অক’ প্রত্যয় যুক্ত হওয়াতে শব্দের আদি-স্বর ‘ই’-কারের পরিবর্তে ‘এ’-কার হয়েছে।

৮. পার্বত্য: (পর্বত + য = পার্বত্য)- প্রত্যয়ের নিয়মে ‘য’ প্রত্যয় যুক্ত হওয়াতে শব্দের আদি-স্বরের বৃদ্ধি হয়। এখানে ‘অ’-কার স্থানে ‘আ’-কার হয়েছে।

৯. অভিষেক: (অভি + সেক = অভিষেক)। ষ-ত্ব বিধানের নিয়মে ‘ই’-কারান্ত উপসর্গের পর ধাতুর দন্ত্য ‘স’ পরিবর্তিত হয়ে মূর্ধন্য ‘ঘ’ হয়েছে।

১০. প্রতিদ্বন্দ্বিতা: (প্রতিদ্বন্দ্বী + তা = প্রতিদ্বন্দ্বিতা)। তা -প্রত্যয় যুক্ত হওয়ায় প্রত্যয়ের নিয়মে পদান্তের ‘ঈ’-কার ‘ই’ কারে পরিবর্তিত হয়েছে।

১১. স্টোভ: ইংরেজি শব্দ। এখানে দন্ত্য ‘স’ ‘ট’ বর্গের সাথে যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও দন্ত্য ‘স’-এর কোনো পরিবর্তন হয় নি। উচ্চারণের দিক থেকে ইংরেজি ‘S’ ধ্বনির জন্য দন্ত্য ‘স’ হয়েছে।

১২. পসারিনী: (পসারী + নী = পসারিনী)। প্রত্যয়ের নিয়মে এখানে ‘নী’ প্রত্যয় যুক্ত হওয়াতে পদান্তের ‘ঈ’ -কার ‘ই’ -কারে পরিণত হয়েছে।

১৩. বৈমানিক: (বিমান + ইক বৈমানিক)। প্রত্যয়ের নিয়মে ‘ইক’ প্রত্যয় যুক্ত হওয়াতে আদি স্বর বৃদ্ধি পেয়ে ‘ই’ -কারের স্থলে ‘ঐ’-কার হয়েছে।

১৪. কারণ: ণ-ত্ব বিধির নিয়ম। ‘র’-এর পর মূর্ধন্য ‘ণ’ হয়।

১৫. সহযোগী: (সহযোগ+ ঈ = সহযোগী)। প্রত্যয়ের নিয়মে ‘ঈ’-কার যুক্ত হয়েছে।

১৬. বর্ণ: ণ-ত্ব বিধানের ‘র’-এর পর মূর্ধন্য ‘ণ’ হয়।

১৭. নিষ্ঠুর: ষ-ত্ব বিধানের নিয়ম। ট, ঠ বর্ণের পূর্বে মূর্ধন্য ‘ষ’ হয়।

১৮. ঐচ্ছিক: (ইচ্ছা + ইক ঐচ্ছিক)। প্রত্যয়ের নিয়মে ‘ইক’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে আদি স্বর ‘ই’-কার স্থানে ‘ঐ’-কার যুক্ত হয়ে আদি স্বরের বৃদ্ধি ঘটেছে।

১৯. ভঙ্গ: কতকগুলো শব্দে কখনো ‘২’ অনুস্বার হয় না। স্বভাবতই ‘৫’ হয়।’

২০. খ্রিস্টাব্দ: বিদেশি শব্দে এই ক্ষেত্রে ‘স’ হয়। কিন্তু বিদেশি আত্মীকৃত শব্দ এবং তৎসম শব্দ তুষ্ট, কৃষ্টি ইত্যাদির মতো উচ্চারিত হওয়ায় বাংলা একাডেমি মূর্ধন্য ‘ষ’ দিয়ে লেখার যুক্তি দেখিয়েছে।

২১. বিষম: (বি+ সম) = বিষম। ‘ই’ কারান্ত উপসর্গ ‘বি’ এর পর ‘সম’ ধাতু যুক্ত হয়ে, দন্ত্য ‘স’ পরিবর্তিত হয়ে মূর্ধন্য ‘ষ’ হয়েছে।

২২. ধরন: সাধারণত খাঁটি বাংলা বা আ-তৎসম শব্দে র-এর পরে মূর্ধন্য ‘ণ’ না হয়ে দন্ত্য ‘ন’ হয়। ২৩. মন্ত্রিসভা: (মন্ত্রী + সভা = মন্ত্রিসভা)। সভা শব্দটি যুক্ত হওয়াতে পদান্তে ‘ঈ’-কার ‘ই’-কারে পরিণত হয়েছে।

২৪. অভিষেক: (অভি + সেক অভিষেক)। ‘ই’-কারান্ত উপসর্গের পর ‘সেক’ ধাতু যুক্ত হওয়াতে ষ-ত্ব বিধানের নিয়মে দন্ত্য ‘স’ মূর্ধন্য ‘ষ’-তে পরিবর্তিত হয়েছে।

২৫. পৌনঃপুনিক: (পুনঃপুনঃ + ইক পৌনঃপুনিক)। প্রত্যয়ের নিয়মেই ‘ইক’ প্রত্যয় যুক্ত হওয়াতে শব্দের আদিস্বরের বৃদ্ধি হয়ে ‘উ’-কারের পরিবর্তে ‘ঔ’-কার হয়েছে।

২৬. ঐতিহাসিক: (ইতিহাস + ইক = ঐতিহাসিক)। ‘ইক’ প্রত্যয় যুক্ত হওয়াতে আদি স্বরের বৃদ্ধি হয়ে ‘ই’-কারের পরিবর্তে ‘ঐ’-কার হয়েছে।

প্রত্যয়ঘটিত কারণে কতিপয় নিম্নরেখ বানানের নিয়মঃ

  1. শান্তি, ভ্রান্তি, শ্রান্তি: প্রত্যয়ঘটিত কারণে ‘তি’ প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে বলে মূল স্বর অন্যরূপ ধারণ করেছে। যেমন: সম + তি = শান্তি, ভ্রম + তি = ভ্রান্তি, শ্রম + তি = শ্রান্তি।
  2. মমত্ব, বন্ধুত্ব, ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, মনুষত্ব, পশুত্ব, দেবত্ব: ত্ব প্রত্যয় যুক্ত হওয়ায় শব্দের শেষে স্বরবর্ণ থাকলে এরূপ হয়। যেমন: মম + ত্ব = মমত্ব, বন্ধুত্ব = বন্ধুত্ব, নেতৃ + ত্ব = নেতৃত্ব, মনুষ্যত্ব = মনুষত্ব, পশু + ত্ব = পশুত্ব, দেব+ত্ব = দেবত্ব।
  3. প্রতিযোগিতা, সহযোগিতা, উপযোগিতা, সহমর্মিতা : ‘তা’ প্রত্যয় যুক্ত হওয়ায় ‘ঈ’-কার ‘ই’-কারে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন: প্রতিযোগী + তা = প্রতিযোগিতা, সহযোগী + তা = সহযোগিতা, উপযোগী + তা = উপযোগিতা, সহমর্মী + তা = সহমর্মিতা।
    অনুরূপ নিয়মে : বিপথগামিতা, অনুরাগিনী, ভিখারিনী, বিজয়িনী, পসারিনী, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অপকারিত, প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
  4. সেবক, পাচক, নর্তক, লেখক, নায়ক , গায়ক, পাঠক, রজক: প্রত্যয়ঘটিত কারণে ‘ অক’ যুক্ত হওয়ায় ধাতুর মূল স্বরের পরিবর্তন হয়েছে। যেমন: সেব্‌ + অক = সেবক, পচ + অক = পাচক, নৃৎ + অক = নর্তক, লিখ + অক = লেখক, নে + অক = নায়ক, গৈ + অক = গায়ক, পঠ+ অক = পাঠক।
    অনুরূপভাবে, সাধ্ + অক = সাধক, শাস্ + অক = শাসক, দৃশ্ + অক = দর্শক, জন + অক = জনক হবে।
  5. আধিক্য, পার্বত্য, সৌভাগ্য, রম্য, বাক্য: প্রত্যয়ঘটিত কারণে ‘ষ’ যুক্ত হওয়ায় মূল স্বর বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন : অধিক + য = আধিক্য, পর্বত + য = পার্বত্য, সুভগ + য = সৌভাগ্য, রম + য = রম্য, বচ + য = বাক্য।
    অনুরূপ নিয়মে : অলস + য = আলস্য, অভিজাত + য = আভিজাত্য, গৃহস্থ + য = গার্হস্থ্য, দরিদ্র + য = দারিদ্র্য হবে।
  6. বার্ষিক, ধার্মিক, মানসিক, দৈনিক, মানবিক, নাগরিক প্রত্যয়ঘটিত কারণে ‘ষ্ণিক’ যুক্ত হওয়ায় মূল স্বরের পরিবর্তন হয়েছে। যেমন: বর্ষ + স্পিক = বার্ষিক, ধর্ম + ষ্ণিক = ধার্মিক, মান + ষ্ণিক = মানসিক, দিন + ষ্ণিক = দৈনিক, মানব+ ষ্ণিক = মানবিক, নগর+ ষ্ণিক = নাগরিক।
  7. সাংবাদিক, ভৌগোলিক, পৌনঃপুনিক, পারলৌকিক প্রত্যয়ঘটিত কারণে ‘ইক’ প্রত্যয় যুক্ত হওয়ায় মূল স্বরের পরিবর্তন হয়েছে। যেমন: সংবাদ + ইক = সাংবাদিক, ভূগোল + ইক = ভৌগোলিক, পুনঃপুনঃ + ইক = পৌনঃপুনিক, পরলোক + ইক = পারলৌকিক।
  8. অধিদৈবিক, ঔপন্যাসিক, ঔপনিবেশিক, সার্বভৌমিক: প্রত্যয়ঘটিত কারণে ‘ইক’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে মূল স্বরের পরিবর্তন হয়েছে। যেমন: অধিদেব + ইক = অধিদৈবিক, উপন্যাস + ইক = ঔপন্যাসিক, উপনিবেশ + ইক = ঔপনিবেশিক, সর্বভূমি+ ইক = সার্বভৌমিক।

‘হ্রস্ব-ই’ কার ও ‘দীর্ঘ-ঈ’ কার  ব্যবহারের কিছু নিয়ম

১. বিশেষ্য শব্দের শেষ ‘দীর্ঘ-ঈ’ যোগ করলে বিশেষণ তৈরি হয়।

যেমন : উৎসাহ > উৎসাহী, ঋণ > ঋণী, লোভ > লোভী, ত্যাগ > ত্যাগী, গৃহ > গৃহী, ধন > ধনী, পাপ > পাপী ইত্যাদি।

২. কোনো শব্দের শেষে যদি ‘দীর্ঘ-ঈ’ কার থাকে এবং তার পরে যদি ত্ব /তা/ণী/নী /সভা/পরিষদ/ভাব/ভাবে/তত্ত্ব /বিদ্যা/জগৎ/বাচক ইত্যাদি যুক্ত হয় তবে ঐ শব্দের শেষের ‘দীর্ঘ-ঈ’ কার ‘হ্রস্ব-ই’ কার হয়ে যাবে।

যেমন : অধিকারী>অধিকারিত্ব, একাকী>একাকিত্ব, প্রাণী>প্রাণিজগৎ, মন্ত্রী>মন্ত্রিপরিষদ, অধিকারী>অধিকারিণী ইত্যাদি।

৩. স্ত্রীলিঙ্গ-বাচক শব্দের শেষে ‘দীর্ঘ-ঈ’ কার হবে।  যেমন : গাভী, দাসী, রানী, মানবী, যুবতী, নেত্রী ইত্যাদি।

৪. সন্ধির একটি নিয়ম আছে: ‘হ্রস্ব-ই’ কার + ই = ‘দীর্ঘ-ঈ’ কার, ‘হ্রস্ব-ই’ কার + ঈ = ‘দীর্ঘ-ঈ’ কার, ‘দীর্ঘ-ঈ’ কার + ই = ‘দীর্ঘ-ঈ’ কার, ‘দীর্ঘ-ঈ’ কার + ঈ = ‘দীর্ঘ-ঈ’ কার; কোনো শব্দ যদি সন্ধি করার ফলে তৈরি হয়, তবে সে-সব ক্ষেত্রে ঐ নিয়মগুলো প্রয়োগ করলেই বানান নির্ভূল হবে। যেমন :

রবি+ইন্দ্র = রবীন্দ্র পরি+ঈক্ষা = পরীক্ষাভর্তি+ইচ্ছু = ভর্তীচ্ছু বারি+ইন্দ্র = বারীন্দ্রঅধি+ঈশ্বর =অধীশ্বর সুধী+ইন্দ্র =সুধীন্দ্র

শব্দের শেষে ‘-ইক’ প্রত্যয় যুক্ত হলে বানানের নিয়ম

শব্দের শেষে ‘-ইক’ প্রত্যয় যুক্ত হলে বানানে কিছু পরিবর্তন আসে।

১. শব্দের প্রথমে ‘অ-কার’ থাকলে তা পরিবর্তিত হয়ে ‘আ-কার’ হবে।

যেমন : অঙ্গ>আঙ্গিক, পরলোক>পারলৌকিক, জগৎ>জাগতিক, গণিত>গাণিতিক, অভিধান>আভিধানিক ইত্যাদি।

২. শব্দের প্রথমে ‘ই-কার’; ‘ঈ-কার’ এবং ‘এ-কার’ থাকলে তা পরিবর্তিত হয়ে ‘ঐ-কার’ হবে।

যেমন : ইচ্ছা>ঐচ্ছিক, পিচাশ>পৈশাচিক, নীতি>নৈতিক, এক>ঐকিক, দেহ>দৈহিক, হেমন্ত>হৈমন্তিক ইত্যাদি।

৩. শব্দের প্রথমে ‘উ-কার’; ‘ঊ-কার’ এবং ‘ও-কার’ থাকলে তা পরিবর্তিত হয়ে ‘ঔ-কার’ হবে।

যেমন : উপন্যাস>ঔপন্যাসিক, মুখ>মৌখিক, ভূগোল>ভৌগোলিক, কোণ>কৌণিক, লোক>লৌকিক ইত্যাদি।

বানানে ঙ / ং-এর ব্যবহার :-

১ – সন্ধিতে (তৎসম শব্দে) প্রথম পদের শেষে থাকলে ক-বর্গের পূর্বে ম স্থানে ং (অনুব্বার) হবে।

যেমন – অহংকার (অহম্ +কার), কিংকর, কিংবদন্তি, ঝংকার, ভয়ংকর, সংকল্প, সংকীর্ণ, সংগীত, সংঘ, সংঘাত, হুংকার।

২ – উপযুক্ত নিয়মে সন্ধিজাত না হলে, যুক্তব্যঞ্জনে ক-বর্গের পূর্বে স্ স্থানে ঙ (উয়ে)) হবে।

যেমন – আকাঙ্ক্ষা, অঙ্কুর, অঙ্গ, ইঙ্গিত, উচ্ছৃঙ্খল, কঙ্কাল, কাঙ্ক্ষিত, গঙ্গা, জঙ্গি, দাঙ্গা, পঙ্কজ, পঙ্গু, বঙ্গ, ভঙ্গি, লঙ্ঘন, শিক্ষাঙ্গন, সঙ্গী।

৩ – প্রত্যয় ও বিভক্তিহীন শব্দের শেষে (অনুস্বার) ব্যবহৃত হয়।

যেমন – আড়ং, ইদানীং, এবং, ঠ্যাং, ঢং, পালং, ফড়িং, বরং, রং, শিং।

৪ – তবে অনুষারযুক্ত শব্দে প্রত্যয়, বিভক্তি বা স্বরবর্ণ যুক্ত হলে ং স্থলে ঙ লেখা হবে।

যেমন – আড়ঙে, টঙে, ঢঙে, ফড়িঙের, রঙিন, রাঙিয়ে।

বানানে বিসর্গ (ঃ)-এর ব্যবহার :-

১ – পদমধ্যস্থ বিসর্গ থাকবে।

যেমন – অন্তঃস্থ, দুঃখ, দুঃসহ, নিঃশব্দ, পুনঃপুন, স্বতঃস্ফূর্ত।

২ – পদান্তে বিসর্গ (ঃ) থাকবে না।

যেমন – ক্রমশ, দ্বিতীয়ত, প্রথমত, প্রধানত, বস্তুত, মূলত।

৩ – অভিধানসিদ্ধ হলে পদমধ্যস্থ বিসর্গ বর্জনীয়।

যেমন – দুস্থ, নিশ্বাস, নিস্পৃহ, বহিস্থ, মনস্থ।

বানানে এ, অ্যা – এর ব্যবহার

বাংলায় এ বর্ণ বা ে-কার দিয়ে এ এবং অ্যা এই উভয় ধ্বনি নির্দেশিত হয়। যেমন: কেন, কেনো (ক্রয় করো); খেলা, খেলি; গেল, গেলে, গেছে; দেখা, দেখি; জেন, যেন। তবে তদ্ভব এবং বিশেষভাবে দেশি শব্দ রয়েছে যেগুলির ্যা-কার যুক্ত রূপ বহুল পরিচিত। যেমন: ব্যাঙ, ল্যাঠা। এসব শব্দে ্যা অপরিবর্তিত থাকবে। বিদেশি শব্দে ক্ষেত্র-অনুযায়ী অ্যা বা ্যা-কার ব্যবহৃত হবে। যেমন: অ্যাকাউন্ট, অ্যান্ড (and), অ্যাসিড, ক্যাসেট, ব্যাংক, ভ্যাট, ম্যানেজার, হ্যাট (Hat)।

বানানে ও – এর ব্যবহার

বাংলা অ-ধ্বনির উচ্চারণ বহু ক্ষেত্রে ও-র মতো হয়। শব্দশেষের এসব অ-ধ্বনি ও-কার দিয়ে লেখা যেতে পারে। যেমন:
কালো, খাটো, ছোটো, ভালো;
এগারো, বারো, তেরো, পনেরো, ষোলো, সতেরো, আঠারো;
করানো, খাওয়ানো, চড়ানো, চরানো, চালানো, দেখানো, নামানো, পাঠানো, বসানো, শেখানো, শোনানো, হাসানো;
কুড়ানো, নিকানো, বাঁকানো, বাঁধানো, ঘোরালো, জোরালো, ধারালো, প্যাঁচানো;
করো, চড়ো, জেনো, ধরো, পড়ো, বলো, বসো, শেখো;
করাতো, কেনো, দেবো, হতো, হবো, হলো;
কোনো, মতো।

ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় শব্দের আদিতেও ও-কার লেখা যেতে পারে। যেমন: কোরো, বোলো, বোসো।

বানানে মূর্ধন্য ণ, দন্ত্য ন এর ব্যবহার

অতৎসম শব্দের বানানে ণ ব্যবহার করা হবে না। যেমন:
অঘ্রান, ইরান, কান, কোরান, গভর্নর, গুনতি, গোনা, ঝরনা, ধরন, পরান, রানি, সোনা, হর্ন।
তৎসম শব্দে ট ঠ ড ঢ-য়ের পূর্বে যুক্ত নাসিক্যবর্ণ ণ হয়, যেমন:
কণ্টক, প্রচণ্ড, লুণ্ঠন।
কিন্তু অতৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ট ঠ ড ঢ-য়ের আগে কেবল ন হবে। যেমন:
গুন্ডা, ঝান্ডা, ঠান্ডা, ডান্ডা, লন্ঠন।

বানানে শ, ষ, স এর ব্যবহার

বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে ‘ষ’ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। যেমন:
কিশমিশ, নাশতা, পোশাক, বেহেশ্ত, শখ, শয়তান, শরবত, শরম, শহর শামিয়ানা, শার্ট, শৌখিন;
আপস, জিনিস, মসলা, সন, সাদা, সাল (বৎসর), স্মার্ট, হিসাব;
স্টল, স্টাইল, স্টিমার, স্ট্রিট, স্টুডিয়ো, স্টেশন, স্টোর।
ইসলাম, তসলিম, মুসলমান, মুসলিম, সালাত, সালাম;
এশা, শাওয়াল (হিজরি মাস), শাবান (হিজরি মাস)।

ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশি ং ধ্বনির জন্য স এবং –ংয, -ংরড়হ, -ংংরড়হ, -ঃরড়হ প্রভৃতি বর্ণগুচ্ছ বা ধ্বনির
জন্য শ ব্যবহৃত হবে। যেমন:
পাসপোর্ট, বাস;
ক্যাশ;

টেলিভিশন;
মিশন, সেশন;
রেশন, স্টেশন।
যেখানে বাংলায় বিদেশি শব্দের বানান পরিবর্তিত হয়ে স ছ-এর রূপ লাভ করেছে সেখানে ছ-এর ব্যবহার থাকবে। যেমন: তছনছ, পছন্দ, মিছরি, মিছিল।

রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত:

রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত হবে না। এই নিয়ম তৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি সকল শব্দের বেলায় প্রয়োজ্য হবে।

উদাহরণঃ – আর্চনা, কার্তিক, বার্ধক্য, সর্ব, ধর্ম, কর্জ, ফর্মা, জার্মানি, শর্ত ইত্যাদি।

সন্ধি হলে ‘ম’ স্থানে অনুস্বার (ং):

সন্ধির সময় পদের অন্তস্থিত ম-এর পর যদি ক, খ, গ, ঘ থাকে, তাহলে ‘ম’ এর স্থানে অনুস্বার (০) লিখতে হবে। অনুস্বার এর স্থানে বিকল্প হিসেবে ‘ঙ’ লেখা যাবে।

উদাহরণঃ – অহংকার, (বিকল্প হিসেবে অহঙ্কার)। প্রলয়ংকর, (বিকল্প হিসেবে প্রলয়ঙ্কর)।

হস্ চিহ্ন:

শব্দ উচ্চারণের সময় শব্দান্তে ‘অ’ এর উচ্চারণ অনেক ক্ষেত্রে সঠিক হয় না। এজন্য অনেক শব্দের শেষে হস চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় এই চিহ্ন ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।

উদাহরণঃ – মাল, টক, জজ, পকেট, হুক ইত্যাদি।

উ, ঊ-কার:

(ক) তৎসম শব্দে উ-কার অপরিবর্তিত থাকে।

উদাহরণঃ- মূল, বধূ ইত্যাদি।

তবে তদ্ভব ও বিদেশি শব্দে কেবল উ-কার হয়।

উদাহরণঃ – কবুল, চুন, খুশি, বুড়ি ইত্যাদি।

(খ) ক্রিয়াবাচক শব্দে শুধু উ-কার ব্যবহৃত হয়।

উদাহরণঃ – বসুন, করুন, ঘুমানো ইত্যাদি।

693 Views
No Comments
Forward Messenger
2
বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ | বাংলা ২য় পত্র ব্যাকরণ | একাদশ-দ্বাদশ | এইচএসসি (HSC)
-
- -
বাক্য ও বাক্যের প্রকারভেদ | বাংলা ২য় পত্র ব্যাকরণ | একাদশ-দ্বাদশ | এইচএসসি (HSC)
-
- -
বাক্যের রুপান্তর | বাংলা ২য় পত্র ব্যাকরণ | একাদশ-দ্বাদশ | এইচএসসি (HSC)
-
- -
ক্রিয়ার ভাব | বাংলা ২য় পত্র ব্যাকরণ | একাদশ-দ্বাদশ | এইচএসসি (HSC)
-
- -
সমাস | বাংলা ২য় পত্র ব্যাকরণ | একাদশ-দ্বাদশ | এইচএসসি (HSC)
-
- -
প্রকৃতি ও প্রত্যয় | বাংলা ২য় পত্র ব্যাকরণ | একাদশ-দ্বাদশ | এইচএসসি (HSC)
-
- -
বাংলা শব্দ গঠন পদ্ধতি | বাংলা ২য় পত্র ব্যাকরণ | একাদশ-দ্বাদশ | এইচএসসি (HSC)
-
- -
ব্যাকরণিক শব্দশ্রেণি | বাংলা ২য় পত্র ব্যাকরণ | একাদশ-দ্বাদশ | এইচএসসি (HSC)
-
- -
পদ | বাংলা ২য় পত্র ব্যাকরণ | একাদশ-দ্বাদশ | এইচএসসি (HSC)
-
- -
উচ্চারণ রীতি | বাংলা ২য় পত্র ব্যাকরণ | একাদশ-দ্বাদশ | এইচএসসি (HSC)
-
- -
No comments to “বাংলা বানানের নিয়ম | বাংলা ২য় পত্র ব্যাকরণ | একাদশ-দ্বাদশ | এইচএসসি (HSC)”